E-Paper

সমস্যার বীজ

বজ্র আঁটুনির পাশে রয়ে গিয়েছে মস্ত এক ফস্কা গেরো— মন্দ বীজের জন্য উৎপাদন মার খেলে চাষি কী করে ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা খসড়া আইনে স্পষ্ট নয়।

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:১৯

উচ্চমানের বীজ যথেষ্ট পরিমাণে জোগান দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্র তৈরি করেছে খসড়া বীজ আইন (২০২৫)। নতুন আইনের প্রয়োজন রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই— একবিংশ শতকের কৃষিপ্রযুক্তি, কৃষি-বাণিজ্যের নিরিখে বহু আগেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে ১৯৬৬ সালের বীজ আইন। কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দফতরের দাবি, নিম্ন মানের বীজ দিয়ে চাষ করার ক্ষতিতে রাশ টানতে পারবে নতুন আইন। কিন্তু আপত্তি উঠেছে, মান নিয়ন্ত্রণের অছিলায় এই আইন কার্যত বীজ উৎপাদন ও বিপণনকে বৃহৎ সংস্থাগুলির কুক্ষিগত করবে। চাষিদের নিজস্ব সংগঠন (ফার্মার্স প্রডিউসার কোম্পানি, মহিলাদের বীজ সমবায়, পরম্পরাগত বীজ সংরক্ষণ সংস্থা) পিছু হটবে কৃষির বাজার থেকে। চাষির স্বার্থের সুরক্ষার চেয়ে কৃষি-বাণিজ্যের স্বার্থই সুরক্ষিত হবে বেশি। আপাতত খসড়া বিল রয়েছে সরকারি ওয়েবসাইটে, জনমত সংগ্রহের পর্ব চলছে। খসড়া আইনের বয়ান থেকে এটুকু অন্তত পরিষ্কার যে, কেন্দ্রের অন্যান্য আইনের মতো বীজ আইনেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের মূল ঝোঁকটি পুরোমাত্রায় উপস্থিত— নথিভুক্তি, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ। পরিযায়ী শ্রমিকের খাদ্যসুরক্ষা, ভুয়ো বীজ থেকে চাষির সুরক্ষা থেকে শুরু করে চোরের থেকে ফোনের মালিকের সুরক্ষা— যে কোনও সঙ্কটের নিরসনে কেন্দ্র সর্বাগ্রে ডিজিটাল নজরদারির পরিধিতে সব পক্ষের প্রবেশকে নিরাপত্তার আবশ্যক শর্ত করে তুলতে চায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি— কিছু পরম্পরাগত বীজ ছাড়া সব বীজ নথিভুক্ত করতে হবে; বীজের মজুতদার (ডিলার) এবং সরবরাহকারীদের (ডিস্ট্রিবিউটর) সরকারি সার্টিফিকেট নিতে হবে; বীজের প্রতিটি বাক্সে থাকতে হবে ‘কিউআর কোড’ যা পাওয়া যাবে কেবলমাত্র কেন্দ্রের পোর্টাল থেকে। চাষি বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিক্রি করতে পারবেন, তবে কোনও ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করতে পারবেন না। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে বীজ কমিটি তৈরি হবে, আইনের রূপায়ণে নজর রাখার জন্য।

এত বজ্র আঁটুনির পাশে রয়ে গিয়েছে মস্ত এক ফস্কা গেরো— মন্দ বীজের জন্য উৎপাদন মার খেলে চাষি কী করে ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা খসড়া আইনে স্পষ্ট নয়। আইন বলছে, বীজ ব্যর্থ হওয়ার জরিমানাও পাবে সরকার, চাষি নয়। অতএব ধানের শিষে চাল না এলে, সূর্যমুখী ফুলে বীজ না এলে, কিংবা দামি বীজ লাগিয়েও ফলন অত্যন্ত কম হলে, সেই আদালতেই যেতে হবে চাষিকে। সে সামর্থ্য ক’জন চাষির রয়েছে? দ্বিতীয়ত, সরকারি পরীক্ষায় পাশ করার যে শর্তগুলি রাখা হয়েছে— নানা এলাকায়, নানা ধরনের আবহাওয়ায়, একই আকার ও বৈশিষ্ট্যের ফসল উৎপাদন— তাতে দিশি বীজের চেয়ে সঙ্কর (হাইব্রিড) বীজ পাশ করার সম্ভাবনা বেশি। আশঙ্কা, দিশি বীজগুলি খোলা বাজার থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাবে। তৃতীয়ত, বীজ উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে চাষিদের সংগঠনগুলিকে ‘বাণিজ্যিক সংস্থা’ হিসাবে ধরছে নতুন আইন। কিন্তু ডিজিটাল নথিভুক্তি, অনলাইনে নানা তথ্য জমা দেওয়া, কিউআর কোড পাওয়া, কৃষি দফতরের সঙ্গে নিয়মিত ডিজিটাল আদান-প্রদান চাষিদের পক্ষে কঠিন। বড় সংস্থার আধিপত্যের ফলে বীজের দাম যদি ছোট চাষির হাতের বাইরে চলে যায়, তা হলে ঘরে-রাখা বীজে চাষে বাধ্য হবেন তাঁরা। উৎপাদন মার খাবে।

এই আপত্তিগুলির যথেষ্ট ওজন রয়েছে। তবে কৃষি আন্দোলনের ফলে কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহারের পরে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারহীনতার জন্য যে অচলাবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা-ও চলতে পারে না। বীজের মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ করতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি, ছোট চাষি যাতে সুলভে উন্নত মানের বীজ পান, তা-ও দেখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রায় অর্ধেক চাষি নিজেদের তৈরি বীজ ব্যবহার করতে বাধ্য হন, তাই তাঁদের ফসলের মান ও পরিমাণ আশানুরূপ হয় না। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষির কাছে চাষ লাভজনক হবে কী করে, এর স্পষ্ট দিক-নির্দেশিকা থাকতে হবে কেন্দ্র বা রাজ্যের কৃষি-বিষয়ক কোনও আইনে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Seeds Bill

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy