কয়েক দিনের উৎসব যখন কয়েক মাসের জন্য নাগরিকের তুমুল দুর্ভোগের কারণ হয়, তখন পুজোর আনন্দ বলে কিছু বাঁচে আর? সম্বৎসরই এই প্রশ্নের জ্বালায় জর্জরিত বঙ্গজীবন, বিষ বেড়ে যায় শ্রেষ্ঠ উৎসবটির সমাগমে। এ বছরের উৎসবের যন্ত্রণার মুখ হয়ে উঠেছেন নলিন সরকার স্ট্রিটের পল্লিবাসীবৃন্দ। কে না জানে সেখানে বরাবরই পথ হারায় মণ্ডপের গর্ভে, ফলে প্রাত্যহিক প্রয়োজনে হাঁটাচলাই দায়। কাতর বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ, পীড়িত বৃদ্ধা পর্যন্ত পুজোর প্রতাপে ঘরছাড়া। অ্যাম্বুল্যান্স তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছে না। বিহিত চেয়ে নগরপালকে চিঠি লিখেছেন প্রায় নবতিপর স্বামী। পুজোকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞান ও সাহায্যের আশ্বাস কতখানি ঠুনকো— এই দুর্দশার চিত্রটুকুই সাক্ষ্য। নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার যে আইন রয়েছে তা অমান্য করেই চলেছে উৎসবের হুজুগ এবং রাজনৈতিক রক্তচক্ষু।
পুজোর আয়োজন প্রসঙ্গে ২০০৯ থেকেই আদালতের নিয়ম নির্দিষ্ট। বলা আছে, মণ্ডপ চার পাশের বাড়ির দেওয়াল, স্থায়ী নির্মাণ ইত্যাদি থেকে চার ফুট দূরে থাকবে, উচ্চতা চল্লিশ ফুটের বেশি ছাড়াবে না, মণ্ডপ দিয়ে যেন দমকল যেতে পারে, জরুরিভিত্তিক প্রবেশ-বাহিরের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে ইত্যাদি। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা দরকার যে, রাস্তা বন্ধ করে মণ্ডপ নির্মাণকে অপরাধ রূপে গণ্য করাই সমীচীন। এ নিয়ে নানা মামলায় পুজো উপলক্ষে আদালতের বিশেষ বিবেচনার সুযোগ নিয়ে অন্যায় ঘটিয়েই চলেছেন পুজোকর্তারা। এলাকার ঐতিহ্য, এত বাধানিষেধ মেনে পুজো করা যায় না— এমনতর হুঙ্কারে নিয়মাবলিকে দাবড়ে দেওয়াকে মাতব্বরির অভিজ্ঞান ঠাওরেছেন। ফলত, গলির জন্য সুবিদিত কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং শহরতলির বহু বাসিন্দারই শান্তি ও অধিকারের উপর পেরেক ঠোকা চলে পুজোর আগে ও পরে মাসাধিক কাল। যাত্রাপথ কাড়ে মণ্ডপের সরঞ্জাম, বাঁশের কাঠামো ও ছিটিয়ে রাখা বিবিধ ক্ষুরধার বিপজ্জনক সামগ্রী। নিজের বাড়িতে ঢুকতে দু’কিলোমিটার বাড়তি ঘুরতে বাধ্য করা হয়, বড় পুজোর ক্ষেত্রে যোগ হয় বিশেষ পাস দেখিয়ে তবে নিজের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি। পুজোর আগেপিছে রাস্তা জোড়া এত কাঠামো, দর্শনার্থীদের স্রোত সামলাতে গলি বন্ধ করার রীতি যানজটকে তীব্র করে। ফলাফল হতে পারে দুর্ঘটনা। নাগরিকের এতখানি ভোগান্তি এবং বিপদের সম্ভাবনা যেখানে, সেখানে ঐতিহ্য, আবেগের অজুহাত কি জনকল্যাণের চেয়ে বড়?
পুজো বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। ইতিপূর্বেই আদালত পুজো মণ্ডপগুলির জন্য প্রশাসনকে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছিল, সেটিকেই পাখির চোখ করা বিধেয়। ইচ্ছা থাকলে সুবিধাজনক স্থানে উৎসব পালন, রাস্তা যুক্তিসঙ্গত ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। স্থানাভাবে মণ্ডপ ছোট করে, বিকল্প পথের ব্যবস্থা রেখে উৎসবের কথা ভাবতে বাধ্য করতে হবে। রাস্তার বদলে কর্মশালায় পুজো-প্রস্তুতির কাজ সারা, নিরাপদ ও সহজে খোলা যায় এমন মণ্ডপ পরিকল্পনাও কঠিন নয়। পুলিশকে অনড় থাকতে হবে যে, বিধিগুলিতে শৈথিল্য দেখালে পুজোর অনুমোদন কিছুতেই মিলবে না। বিন্দুমাত্র অসুবিধার উদ্রেকেই পুরস্কারের তালিকা থেকে নাম বাদ, এমনকি অনুদান বন্ধের নিদান ফলপ্রসূ হতে পারে। পুজোর মস্তানিকে শায়েস্তা করতে যথোপযুক্ত শাস্তি বিনা গতি নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)