শিক্ষকরা গড়পড়তা সরকারি কর্মী নন। তাঁদের উপর ন্যস্ত এক গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। সুতরাং, শিক্ষাদান-বহির্ভূত কাজে তাঁরা দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকলে পঠনপাঠন চলবে কোন উপায়ে— এই প্রশ্নটি অতি জরুরি। প্রতি নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচনী কাজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগ করা হয়। তদুপরি, সম্প্রতি রাজ্যে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ। রাজ্যে ইতিমধ্যে বুথের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় এক লক্ষের কাছে। সুতরাং, সমসংখ্যক বিএলও-দেরও প্রয়োজন। বিএলও হিসাবে যে স্থায়ী পদে কর্মরত কর্মী-আধিকারিকদেরই নিয়োগ করতে হবে— জাতীয় নির্বাচন কমিশন ইতিপূর্বেই তার নির্দেশ জারি করেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে স্থায়ী সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের একাংশকেও নিযুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে, উঁচু শ্রেণিতে নতুন ধরনের পরীক্ষাব্যবস্থা চলাকালীন এক বড় সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর বিদ্যালয়ের বাইরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আশঙ্কা। বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগের।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। এমনিতেই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অধোগমন চোখে পড়ার মতো। সরকারি এবং সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলি ভগ্নপ্রায় পরিকাঠামো, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে তীব্র অসামঞ্জস্য এবং সরকারি অবহেলার শিকার হয়ে বহু দিন ধরেই ধুঁকছিল। তার উপরে খাঁড়ার ঘা-টি দিয়ে আদালতের নির্দেশে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে। অবশিষ্ট যেটুকু আছে, সেটুকু নিয়েই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে যেতে হলে একটি পাঠদিবসও নষ্ট করা উচিত নয়। তা ছাড়া, শিক্ষকরা শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের নির্দিষ্ট সময়টুকুতেই আবদ্ধ থাকেন না। বিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক কাজ, পরীক্ষার খাতা দেখা, প্রশ্নপত্র তৈরি-সহ অসংখ্য কাজেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁরা। এক দিকে নতুন নিয়োগ বন্ধ, অন্য দিকে কয়েক হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ায় কর্মরত শিক্ষকদের উপর দায়িত্বের পরিমাণটি অনুমান করা অসম্ভব নয়। সেই পরিস্থিতিতে ফের তাঁরা ভোটার তালিকার মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হলে কী ভাবে বিদ্যালয়ের কাজটিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারবেন? এই দুইয়ের টানাটানিতে কি শেষ পর্যন্ত এই রাজ্যের শিক্ষার্থীরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, যাদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক এখনও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাতেই আস্থা রেখেছে?
গত বছরে জানা গিয়েছিল, বহু স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় অনুপস্থিতির হার ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ছুঁয়েছে। এ-ও জানা গিয়েছিল দ্বাদশ শ্রেণির ওই পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে ট্যাব কেনার জন্য সরকার প্রদত্ত দশ হাজার ঢোকার পরই তারা পাঠছুট হয়। এই বছর নতুন ব্যবস্থায় উচ্চ মাধ্যমিকের তৃতীয় সিমেস্টারের পরীক্ষা সামনেই। এখন শিক্ষকেরা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পরীক্ষা প্রস্তুতির কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। আজকাল সামান্য উপলক্ষে দীর্ঘ, অকারণ ছুটির প্রতি রাজ্য সরকারের দৃষ্টিকটু সমর্থন। স্কুলের পড়াশোনার ছবিটিকে তা আরও বিবর্ণ করে তোলে। ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ জরুরি, কিন্তু শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনকে ব্যাহত করে নয়। দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য কী ভাবে রক্ষা করা যাবে, তা সরকারকেই ভাবতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)