মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের পর দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা। পুলিশের ব্যর্থতার লজ্জা যেন শেষ হওয়ার নয়। অশান্ত পরিস্থিতিতে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে,বিশৃঙ্খল পরিবেশের উপর শক্ত হাতে শৃঙ্খলা আরোপ করবে পুলিশ, এমন প্রত্যাশাই আজ যেন অবাস্তব। ক্ষিপ্ত জনতা সামলাতে গিয়ে বার বার পুলিশ বেসামাল হচ্ছে, আহত হয়ে পিছু হটছে, পুলিশের জিপ, বাইক জ্বলছে, শেষ অবধি র্যাফ না নামলে, বাড়তি বাহিনী না পাঠালে কিছুতেই অশান্তি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এই দৃশ্যগুলি রাজ্যবাসীকে উত্তরোত্তর পুলিশ-প্রশাসন সম্পর্কে সন্দিগ্ধ, ভরসাহীন করে তুলছে। আশঙ্কা হয়, এই শেষ নয়। পুলিশের ভাবমূর্তি যত দুর্বল হবে, ততই আইন নিজের হাতে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাবে। একই পুলিশের দু’টি রূপ দেখছে রাজ্যবাসী— শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শামিল নিরস্ত্র নাগরিককে প্রহারে পুলিশ নির্মম। আর মারমুখী সশস্ত্র জনতার সামনে পুলিশ প্রাণভয়ে পলায়নপর। সম্প্রতি শিক্ষক আন্দোলনে দেখা গেল, ব্যারিকেড টপকানো বা সরকারি দফতরের প্রবেশ পথ অবরুদ্ধ করার মতো ‘গুরুতর অপরাধ’ আটকাতে পুলিশ কেবল লাঠি চালায়নি, যথেচ্ছ লাথি মেরেছে শিক্ষকদের। ‘আইনের শাসন’ জারি রাখার এই প্রবল দায়িত্ববোধ, পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ করার এই অত্যুগ্র বাসনা নিমেষে অন্তর্হিত হয় উন্মত্ত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের সামনে। যখন অসহায় গৃহস্থ প্রাণভয়ে বার বার পুলিশকে ডাকেন, তখন কোথায় থাকে কর্তব্যের জ্ঞান? হামলাকারীদের সংখ্যা বেশি, পুলিশের সংখ্যা কম, তাই মারমুখী জনতাকে দেখে পুলিশ পিছু হটেছে— এই যুক্তি যে পুলিশ দিতে পারে, তা শুনেও সহসা বিশ্বাস হয় না। কবে, কোথায় সংঘর্ষরত মানুষের সংখ্যা পুলিশকর্মীদের চাইতে কম হয়? সংখ্যায় কম হয়েও পুলিশ নিজের অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ, মধ্যস্থতার কৌশল এবং রাষ্ট্রদত্ত ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করে প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
আহত পুলিশকর্মীদের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়েও বলা প্রয়োজন যে, পুলিশ যদি জনমানসে সম্ভ্রমের স্থানটি হারিয়ে ফেলে, তা হলে দুষ্কৃতী বেপরোয়া হবেই। ডিসি পদাধিকারী পুলিশ আধিকারিকের উপরেও বার বার হামলা হচ্ছে। জনজীবনে কর্তৃত্বের স্থানটি হারিয়ে ফেলছে পুলিশ, এ তারই ইঙ্গিত। থানার পুলিশ ‘এলেবেলে,’ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে তার গতিবিধি নির্ধারিত হয়, এমন ধারণার শিকড় সারা রাজ্যে ছড়িয়েছে। বাজারের বসার জায়গা নিয়ে বচসার মতো সামান্য ব্যাপার থেকে অনিয়ন্ত্রিত হিংসার অগ্ন্যুৎপাত তার বিষফল। মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক আক্রমণে গ্রামবাসীকে নিরাপত্তা দিতে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মহেশতলার রবীন্দ্রনগর থানা এলাকায় দেখা গেল, ফলের দোকানিদের ঝগড়া থেকে যার শুরু, তা এক ভয়ানক সংঘর্ষে পরিণত করল পুলিশের ব্যর্থতা। ফলে বাজারের বচসা গড়াল বাড়ি বাড়ি হানা, দোকানে ভাঙচুর, মেয়েদের মারধরে। কেন সংঘাত এত তীব্র হওয়ার আগেই পুলিশ হস্তক্ষেপ করল না, কেন এতখানি ক্ষোভের আন্দাজ আগে থেকেই পুলিশের কাছে ছিল না— জঙ্গিপুরের প্রশ্নগুলির প্রতিধ্বনি শোনা গেল মহেশতলাতেও।
মনে রাখতে হবে, যে মূল্যবান সময় থানার পুলিশ নষ্ট করেছে অতিরিক্ত বাহিনীর অপেক্ষায়, তার মধ্যেই অগণিত নারীপুরুষ হিংসার শিকার হয়েছেন। আগাম খবর না থাকা, সংঘাতের তীব্রতা লঘু করতে না পারা, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনায় বিলম্ব— প্রতিটি ব্যর্থতার তদন্ত প্রয়োজন। কিন্তু তার সম্ভাবনা কতটুকু? বিরোধী বিজেপি ভাঙা তুলসী মঞ্চকে লক্ষ্য করেছে, শাসক দল বেছে বেছে বিজেপি-আরএসএস দুষ্কৃতীদের তুলে ধরছে। আর তদন্তের ফলই বা কী হয়? সংবাদে প্রকাশ, মহেশতলার পরিস্থিতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যে চার জন আইপিএস অফিসারকে, তাঁদের অন্যতম জঙ্গিপুরের সদ্য প্রাক্তন এসপি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)