যার শুরু আছে, কিন্তু শেষের দেখা নেই— সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলিতে গরমের ছুটির অবস্থা এমনই। এই বছর ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে ছুটি। যদিও সরকারি স্কুলের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছুটি পড়ার কথা ছিল ১২ মে। স্কুল খোলার কথা ছিল ২৩ মে। কিন্তু সেই সময়সীমা যে নেহাতই কাগুজে, প্রকৃত ছুটি নির্ধারিত হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা অনুযায়ী, তা এক রকম স্পষ্টই ছিল। ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। ৩ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন— তীব্র গরমের কারণে ৩০ এপ্রিল থেকে স্কুলে ছুটি শুরু হবে। শেষের দিনটি ঘোষণার কথা ছিল শিক্ষা দফতরের, ‘আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি’ দেখে। কিন্তু, এখনও সে বিষয়ে তারা নির্দেশিকা জারি করেনি। অনুমান করা চলে, সেটিও নির্ধারিত স্কুল ক্যালেন্ডার মানবে না। এগারো-বারো দিনের ছুটি শেষাবধি মাসাধিক কাল ধরে চলবে— এমন আশঙ্কাও যথেষ্ট।
এমন ইচ্ছা-ছুটি কোনও সভ্য দেশের শিক্ষা-চিত্র হতে পারে না। শিক্ষাবর্ষের ছুটির ক্যালেন্ডারটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেইমতো পরীক্ষাসূচি স্থির হয়। তার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠ্যক্রম শেষ করতে হয়। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই তার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু পরিবর্তনটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ালে মুশকিল। শিক্ষকদের একাংশেরও অভিযোগ, এই এগিয়ে-আনা ছুটিতে পাঠ্যক্রম শেষ করা দুরূহ। লক্ষণীয়, এই বছর এখনও গরম অসহনীয় হয়ে ওঠেনি। ফলে, আরও কিছু দিন অনায়াসে স্কুল খোলা রাখা যেত। কিন্তু এপ্রিলের গোড়াতেই মুখ্যমন্ত্রী ছুটি ঘোষণা করে দেওয়ায় সে কাজ করা যায়নি। গ্রীষ্ম অসহনীয় হয়ে উঠলেও কি বিকল্প উপায় ছিল না? কিছু দিন ছুটি দিয়ে ফের স্কুল খোলা যেত, স্কুলের সময় এগিয়ে আনা যেত। অথচ, কিছুই ভাবা হল না। উষ্ণায়নের কারণে আগামী দিনে গ্রীষ্ম প্রখরতর হবে। সে ক্ষেত্রে পুরনো সময়সূচি আঁকড়ে থাকলে চলবে না। ভাবনাচিন্তা আবশ্যক ছুটির ক্যালেন্ডার নিয়েও। গ্রীষ্মের ছুটি যদি একান্তই দীর্ঘায়িত হয়, তবে পুজোর ছুটি-সহ অন্য অনাবশ্যক ছুটিগুলি কমিয়ে ভারসাম্য রাখা প্রয়োজন। নয়তো ভোটের ছুটি, দু’টি ছুটির মাঝের কর্মদিবসটিতে ছুটি, একটি ছুটি সপ্তাহান্তে পড়লে তা পুষিয়ে দিতে অন্য দিন ছুটি— এমন চললে শিক্ষার আর কী-ই বা পড়ে থাকে?
অবশ্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ জানিয়েছে, ছুটিতে তৃতীয় সিমেস্টারের পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাস করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে সরকার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে ট্যাব, স্মার্টফোন তুলে দিয়েছে। সুতরাং, অনলাইন ক্লাস করায় সমস্যা নেই— এমনই ধারণা। মনে রাখতে হবে, ট্যাব পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট দূর স্থান, মোবাইল পরিষেবাও ভাল নয়। সেই অঞ্চলের পড়ুয়ারা কী করবে? অতিমারিকাল দেশে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর তত্ত্বটি সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ছুটির চক্রে ফের সেই বিভাজনকে আরও উস্কে দেওয়া কেন? তা ছাড়া দরিদ্র পরিবারে দীর্ঘ ছুটিতে ছেলেমেয়েরা ট্যাব, স্মার্টফোনে শুধুই পড়বে, এমন আশা অলীক। ছেলেরা পরিবারের উপার্জনের কাজে হাত লাগাবে, মেয়েরা গৃহস্থালির কাজে। থাকবে না এক বেলা ভরপেট গরম খাবারের আশ্বাসটুকুও। ছুটিবিলাসী সরকার আর কবে এই দিকগুলি নিয়ে ভাববে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)