এক-একটি ভয়ানক ঘটনা ঘটার পর সাধারণ বোধবুদ্ধির মানুষের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এমন ঘটনার পর, এত বড় দাম দেওয়ার পর, নিশ্চয়ই কিছু শিক্ষা নেওয়া হবে, নিশ্চয়ই আর এই ধরনের ভয়াল পরিস্থিতি তৈরি হবে না। কিন্তু, না। এই ভারতে হয় শাসকমহলে সেই সাধারণ বোধবুদ্ধির নিতান্ত অভাব, নতুবা, শাসকমহল আসলে কোনও দামকেই যথেষ্ট চড়া বলে মনে করে না, তাই শিক্ষা লাভের প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) আইপিএল-এ জয়ী হওয়ার পর তার আনন্দোৎসবে বেঙ্গালুরুতে প্রবল ভিড়ে এগারো জনের পদপিষ্ট হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর কর্নাটকের সরকার যে ভাবে দুঃখপ্রকাশ করেছে, তা দেখে প্রথমেই যেটা মনে হয়— দুঃখ প্রকাশ করার বদলে দুঃখকে রোধ করাই ভাল ছিল, বিশেষত রোধ করার সমস্ত উপায় যখন সরকারের হাতেই ছিল। অনেক ইঙ্গিত উপস্থিত ছিল যে উৎসব পালন করতে বিরাট আকারের ভিড় হতে চলেছে। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের লোকধারণের ক্ষমতার চেয়ে বহুপরিমাণ বেশি জনসমাগম হতে চলেছে। এই বিপুল জনতা কিন্তু আকাশ থেকে স্টেডিয়ামের সামনে আবির্ভূত হয়নি। সহজ বুদ্ধি বলে, যখন ভিড় সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, স্টেডিয়ামগামী যানবাহন আটকে দিয়েই জনতা-নিয়ন্ত্রণ করার হাজারো ব্যবস্থা করা যেতে পারত, এবং সেটা করার ক্ষমতা সরকারেরই ছিল। মেট্রো করে যে হাজারে হাজারে মানুষ স্টেডিয়ামপানে ধাবিত হচ্ছিলেন, অনায়াসে মেট্রো বন্ধ করে তা থামানো যেত। জরুরি পরিস্থিতি বোঝার উপায় সরকারের হাতেই থাকে। সরকার যদি কার্যক্ষেত্রে হাত তুলে বসে থাকে, এবং দুর্ঘটনা ঘটার পর ভূয়সী দুঃখপ্রকাশ করে, তা হলে সাধারণ মানুষের মনে দুঃখের বদলে ক্রোধ সঞ্চারিত হওয়া আশ্চর্য নয়।
এবং ঘটনা ঘটার পর শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি। একের পর এক পুলিশ কর্তাদের সাসপেন্ড করে, শাস্তি দিয়ে, পুলিশবাহিনীর মনোবল ভেঙে একটি দিকে সমস্ত দায় চালিত করে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে পুলিশও শেষ পর্যন্ত সরকারি নির্দেশের আজ্ঞাপালক মাত্র। তারা যন্ত্র। যন্ত্রী হলেন অন্যেরা, নেতারা। সেই অন্যেরা, কী আশ্চর্য, প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি সরকারে, শেষ পর্যন্ত রাজনীতির বদান্যতায় আড়ালেই থেকে যান, এটাই এ দেশের দস্তুর। দুনিয়ায় বহু সভ্য দেশ আছে যেখানে এমন ঘটনা ঘটলে দায়িত্বস্খলনের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হত, এবং শেষ অবধি উচ্চতম স্তর অবধি দায় স্বীকারে বাধ্য হত। শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের এই দায়গ্রহণের সংস্কৃতি ক্রমশই এই দেশ থেকে অন্তর্হিত হচ্ছে বলে এত বড় বড় প্রশাসনিক অন্যায় ও অনাচার সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়, এবং সমানেই পায়ের তলায় চাপা পড়তে থাকে সতেজ জীবনসমূহ।
কেবল রাজ্য প্রশাসন নয়। আরসিবি-র দায়িত্বও বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, কর্নাটক রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ) এবং বিসিসিআই-এরও। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্রিকেটের মতো একটি আদ্যন্ত জনপ্রিয় খেলায় রাজ্যের নামে সমর্থকদের উল্লসিত করার নেশায় না মাতলে ক্রীড়া নামক প্রযোজনা সাফল্যশিখরে ওঠে না, অর্থলগ্নিও সর্বাঙ্গসার্থক হয় না। সুতরাং সীমাহীন ভাবে বাড়ে প্রচার, সুস্থতার দিগন্ত ছাড়িয়ে যায় বিজ্ঞাপন। যে আড়াই লক্ষ মানুষ আনন্দোৎসবে মাততে স্টেডিয়ামে আসছিলেন, গ্রামগঞ্জ থেকে তাঁরা ছুটে এসেছিলেন প্রবল প্রচারের চুম্বকেই। জনতার জন্য সমস্ত গেট খোলা, এমন প্রচারও চলছিল পুরোদমে। পরবর্তী ঘটনা কোথায় পৌঁছবে এ কথা আগাম জানা সম্ভব না হলেও সকল পক্ষকেই আজ ফিরে ভাবতে হবে, এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় কার কার, কোন কোন ভাবে। কেবল ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা ফান্ড তৈরিই যথেষ্ট নয়, আসল ক্ষতটি আসলে তৈরি হয়েছে সামাজিক নৈতিকতার অঙ্গনে। সেই ক্ষত না সারলে এই দেশকে এমন পদপিষ্ট-প্রাণ আরও দেখতে হতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)