E-Paper

কাজ কোথায়

প্রশ্ন হল, অন্য রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে অত্যাচার ঠেকাতে গেলে রাজ্য সরকারকে আগে এই রাজ্যে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে কেন?

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩৭

ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে গেলে কি আগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সবার জন্য (সরকারি) কাজের সংস্থান করতে হবে? বঙ্গ-রাজনীতিতে ইদানীং এমন একটি ভাষ্য ক্রমে দানা বাঁধছে— লক্ষণীয় ভাবে বিরোধী এবং সরকার, উভয় পক্ষ থেকেই। বিরোধীরা বারে-বারেই প্রশ্ন করছেন, এ রাজ্যে কাজ কোথায় যে, মানুষ ঘরে ফেরার সাহস করবেন? খানিকটা যেন এ প্রশ্নের প্রতিক্রিয়াতেই মুখ্যমন্ত্রীও বলে চলেছেন যে, ভিন রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে এলে সবার কাজের ব্যবস্থা করবে সরকার— ‘কর্মশ্রী’ নামক যে প্রকল্পটি এত দিন ছিল জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনার খাতে ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র পাল্টা, সেটিই নাকি এখন ঘরে-ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ জোগাবে। এ দিকে, পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রকল্পে সরকার এত দিন খরচ করেছে যৎসামান্য। ফলে, তাতে কাজের ব্যবস্থা বড় একটা হয়নি; অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কিন্তু, প্রশ্ন হল, অন্য রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে অত্যাচার ঠেকাতে গেলে রাজ্য সরকারকে আগে এই রাজ্যে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে কেন?

পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট কাজ নেই, সে কথা অনস্বীকার্য। কেন নেই, সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলে তার দায়ের একটা বড় অংশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে বর্তাবে, সে কথাও সত্য— ঠিক যেমন, আজ যাঁরা ‘রাজ্যে কেন কাজ নেই’ বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে চাইছেন, নেহাত সংখ্যার তেমন জোর নেই বলে পেরে উঠছেন না, সেই বামপন্থীদেরও রাজ্যে কাজ না থাকার দায় নিতে হবে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই, তাই সে রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে গেলে তাঁদের হেনস্থা করা যায়— এমন যুক্তি নিশ্চয়ই বিজেপিও দিতে চাইবে না, বামপন্থীরাও নন। স্পষ্টতই দুটো আলাদা প্রশ্ন— দুটোকে গুলিয়ে দিতে চাওয়াই রাজনীতি। বিজেপি কেন এই রাজনীতি করতে চায় তা স্পষ্ট; বামপন্থীরাও কেন সে সুরে সুর মেলাচ্ছেন, তা বোঝা দুরূহ। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ভারতীয় সংবিধান দেশের সব নাগরিককে দেশের যে কোনও প্রান্তে যাওয়ার, কাজ করার, বসবাস করার অধিকার দিয়েছে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভিন রাজ্যে গিয়ে হয়রানির শিকার হলে, ভাষাগত কারণে বা ধর্মীয় পরিচিতির কারণে নিগৃহীত হলে প্রতিবাদ করতে হবে দেশের ঐক্যের খাতিরেই। দেশের যে প্রান্তে শ্রমের জন্য সর্বাধিক মজুরি পাওয়া সম্ভব, সেখানে গিয়ে কাজ করার অধিকার প্রত্যেক ভারতবাসীর। তার জন্য তাঁর নিজের রাজ্যে কাজ পাওয়ার সুযোগ কতখানি, সে হিসাব কষার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই।

পশ্চিমবঙ্গে কাজ পাওয়ার সুযোগ কম; মজুরির হারও উন্নত রাজ্যগুলির চেয়ে ঢের কম— এই কথাগুলি সত্য। তার বৃহত্তম কারণ হল, বারে-বারেই রাজনীতি এসে এ রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনাকে নিয়ে গিয়েছে। যে বামপন্থীরা শিল্পের শবসাধনা করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করলেন শিল্পমেধ যজ্ঞের দ্বারা, একে নিয়তির নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কী বা বলা চলে? বড় মাপের শিল্প না থাকলে রাজ্যের কর্মসংস্থানে গতি আসতে পারে না। শুধু বড় শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগের ফলেই কর্মসংস্থান বাড়ে না— সেগুলিকে কেন্দ্র করে যে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠে, কর্মসংস্থানের জন্য সেই বাস্তুতন্ত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে তা নেই, ফলে কাজও নেই। তলানিতে ঠেকা রাজকোষের টাকায় কর্মসংস্থান প্রকল্প তৈরি করে পরিযায়ীদের কাজ দিয়ে এই সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি খামতিকে ঢাকা যায় না। মুখ্যমন্ত্রীকে এ কথাটি বুঝতে হবে। রাজ্যে কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি এক দিনে মেটার নয়। সরকার টাকা দিয়ে সমস্যা মিটিয়ে ফেলবে, বঙ্গ রাজনীতির এই মডেলটিও অপ্রযোজ্য। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চাইলে শিল্পের সাধনায় মনোনিবেশ করা বিধেয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Migrant Labours

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy