বন্ধু আর বন্ধু নেই, ভাবতে গেলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বন্ধু কি সত্যিই বন্ধু ছিল কোনও দিন? দিল্লির সাউথ ব্লকের মনোভুবনে নিশ্চয়ই এই ক্লেশ দিবারাত্র আঘাত দিচ্ছে। এই কয়েক দিন আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী মিত্রতার বড়াই করতে ব্যস্ত দিল্লি এখন একের এক শুল্ক-গুঁতোর জের সামলাতে ব্যস্ত। ট্রাম্প দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে ভারত এখন আমেরিকার শুল্ক-লড়াইয়ের প্রধান টার্গেট। গত বুধবার থেকে ভারতের উপর ২৫ শতাংশ বাণিজ্য শুল্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ২৫ শতাংশ— রাশিয়া থেকে ভারত খনিজ তেল কেনায় তার শাস্তি। এই অতিরিক্ত শুল্কের মেয়াদ কত দিন, এ নিয়ে জল্পনা চলমান। হয়তো বেশি দিন নয়। তবে যত দিনই তা চলুক, তত দিন ভারতের মনঃক্লেশের সঙ্গে জুড়ে থাকবে বাণিজ্যিকঅনিশ্চয়তার বিষয়টি। কূটনীতির বিশ্বে কোনও স্থায়ী বন্ধু হয় না, বাস্তবের এই তিক্ত ওষুধ গিলে ভারত আপাতত রাশিয়া, চিন, জাপান এবং সামগ্রিক ভাবে ব্রিকস গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক পুনর্নবীকরণে মন দিতে ব্যস্ত।
এ মাসের শেষেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চিন ও জাপান সফর। চিনের সঙ্গে বেশ কিছু দ্বন্দ্বময় বিষয়ে কথোপকথন নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ভারত— শত্রুর শত্রু ইত্যাদি পুরনো মন্ত্র মনে করে। তবে কিছু হিসাব যে এমত মথিতমানসেও যথেষ্ট গুরুত্বময়, তাও সাউথ ব্লকের কর্মধারায় স্পষ্ট। যতই ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ এবং এশীয় জোটের ভাবনাচিন্তা চলুক, অর্থনীতির ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া। শেষ অবধি ভারতকে প্রাচ্য অপেক্ষা প্রতীচ্যের উপরেই নির্ভর করতে হবে। আমেরিকায় ভারতের বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ভারত থেকে ব্রিকস-এর দেশগুলিতে সম্মিলিত ভাবে রফতানির থেকেও অনেকটা বেশি। তদুপরি, এশিয়ার কথা ধরলে, ফিলিপিনস ছাড়া প্রায় সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির সম্পর্ক। ফলে অদূর ভবিষ্যতেই ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আশা রাখতে হচ্ছে। কোয়াড বা চতুর্দেশীয় অক্ষের উপর জোর দিয়ে দক্ষিণ চিন সাগরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রাখায় জোর দিতে হচ্ছে।
দুর্ভাগ্য, ভারতের কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একটি কঠিন মেরু হয়ে উঠল যখন এমনিতেই চিন নামক বিশ্বকূটনীতির অপর মেরুটি ভারতের জন্য ক্রমশই আরও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠছে। দক্ষিণ চিন সাগর কূটনীতিতে ভারতে ব্যগ্র অংশগ্রহণই বুঝিয়ে দেয়, চিনা আগ্রাসনের ভয়টি কত সুদূরবিস্তৃত। পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের ঘনত্ব পহেলগাম কাণ্ডেই প্রমাণিত। দিল্লি-বেজিং বিমান পরিষেবা চালু হওয়া সুসংবাদ হতে পারে, কিন্তু পাশাপাশি হিমালয়সীমান্ত বরাবর এগিয়ে আসা চিনা বাহিনীর পিছু হটার চিহ্নটুকুও না থাকা, কিংবা পাকিস্তানে সর্বোচ্চ রেঞ্জের অস্ত্র সরবরাহের বরাত ভারতের কাছে অনেক বড় উদ্বেগ। উপরন্তু ভারতের চার পাশে প্রায় সমস্ত প্রতিবেশী দেশের মর্মসহচর এখন চিন— বাংলাদেশেরও। নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন সফরে এই সব কয়টি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হবে ঠিকই, তবে নতুন দরজা খোলার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তুলনায় জাপানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খানিক আশাময়, জাপান-চিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতও ভারতের পক্ষে অনুকূল। প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, বাণিজ্য ক্ষেত্রে দিল্লি-টোকিয়ো অক্ষ নতুন জোর পাবে আশা করা যাক। সেই দিক দিয়েও কোয়াড কার্যক্রম ভারতের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতেই। অর্থাৎ, এক অদ্ভুত জটিল প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পনীতির ফলে ট্রাম্পের দেশের গুরুত্ব ভারতের কাছে কমেনি, বরং বেড়েছে। উত্তম কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধুও নেই, স্থায়ী শত্রুও নেই। আপাতত এক দিকে চিন ও জাপানের মধ্যে, অন্য দিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মরসুমে দিল্লির এখন দরকার আশাবাদের ডোজ়: খেলা হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)