আজ বিশ্ব জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের প্রতিযোগিতা দ্বারা পুনর্গঠিত হচ্ছে ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক, সরবরাহ শৃঙ্খল কৌশল, এমনকি অর্থনৈতিক নীতিও। গোটা দুনিয়া যত পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে ঝুঁকছে, ততই চাহিদা বাড়ছে লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল এবং রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (আরইই) বা বিরল মৃত্তিকা খনিজের। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হওয়ার পথে। মুষ্টিমেয় দেশ, বিশেষত চিনে, এই সম্পদ কেন্দ্রীভূত থাকায়, বাকি বিশ্বের সঙ্গে ভারতও শক্তি নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এই খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে। যাবতীয় বিরল মৃত্তিকা খনিজের চাহিদা মেটাতে দিল্লি এ-যাবৎ চিনের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বেজিং-এর উপরে এই নির্ভরতা হ্রাস করতে গত এপ্রিলেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার ‘ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল মিনারেল মিশন’ চালু করেছিল। এ বার এই প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে ফেলে দেওয়া বৈদ্যুতিন পণ্য বা পুরনো গাড়ি থেকে বিরল খনিজ পুনরুদ্ধার বা ‘রিসাইক্লিং’-এর উপর জোর দিতে তারা নতুন প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য সিলমোহর পড়েছে ১৫০০ কোটি টাকার উৎসাহ ভাতা প্রকল্পে।
লক্ষণীয়, এই বিরল মৃত্তিকা খনিজ অপরিহার্য বিদ্যুৎচালিত যানবাহন, উইন্ড টারবাইন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও এখনকার বিবিধ ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ক্ষেত্রে। এই খনিজগুলি ভূতাত্ত্বিক ভাবে বিরল না হলেও এদের পরিশোধন ও প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টি মূলত চিনেই কেন্দ্রীভূত। চিন এই সব খনিজের ক্ষেত্রে আজ বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের ৬০-৭০ শতাংশ, প্রক্রিয়াকরণের ৮৫ শতাংশ এবং পরিশোধনের ৮৫-৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু তা-ই নয়, ভূরাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের সূত্রে ক্ষেত্রবিশেষে বেজিংয়ের এই সরবরাহগুলিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ইতিহাসও রয়েছে— যার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমেরিকার শুল্কনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই বিরল খনিজ রফতানির উপরে নিষেধাজ্ঞা। বস্তুত, এর প্রভাব ভারতের উপরেও পড়ছিল। এমতাবস্থায় চিনের উপরে নির্ভরতা হ্রাস করতে অনেকেই এখন ঝুঁকছে বাতিল পণ্য থেকে বিরল মৃত্তিকা খনিজ সংগ্রহ করে তার পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়ার দিকে। ভারত যে-হেতু প্রতি বছর ৩২ লক্ষ টনেরও বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদন করে, যার বেশির ভাগই মূল্যবান বিরল মৃত্তিকা খনিজে সমৃদ্ধ, তাই ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার নিঃসন্দেহে তার আরইই-র চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য থেকে এই ধরনের খনিজ পুনর্ব্যবহার করলে খননকার্য-সহ বিপজ্জনক বর্জ্য অপসারণ হ্রাস পায়, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিও কম হয়।
বিরল মৃত্তিকা খনিজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ভারত এ-যাবৎ পিছিয়ে থেকেছে নানা কারণে। প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, জটিল ও ব্যয়বহুল উত্তোলন প্রক্রিয়া, পরিবেশগত উদ্বেগ, নীতিগত ফাঁকের কারণে। সাম্প্রতিক সঙ্কট ভারতকে একটি কৌশলগত সুযোগ এনে দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে শক্তিশালী সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তুলতে হলে ভারতকে নীতিগত সংশোধন-সহ তার কার্যকর বাস্তবায়ন ছাড়াও উন্নত পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। না হলে তার ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আশা দুরাশাই থেকে যাবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)