E-Paper

জেনেবুঝে ভুল

গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে হঠাৎ হিন্দি-ইংরেজি তুলনা-প্রতিতুলনার দরকার পড়ল কেন, সেই আলোচনা সরিয়ে রেখে বরং এ রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার সেই কথাটি, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে এর আগে বহু বার যা লেখা হয়েছে: ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই।

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৪:৪৯

হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা— বছর শেষ হওয়ার আগে আরও এক বার শোনা গেল সেই বহুশ্রুত এবং ভ্রান্ত কথাটি। সারা বছর ভারতের বর্তমান শাসকদের ছোট-বড় নেতা মন্ত্রী জনপ্রতিনিধিদের মুখে যে কথা বারংবার নানা প্রসঙ্গে শোনা গেছে, এমনকি বিজেপির অ-হিন্দিভাষী তথা বাঙালি সমর্থককুলও যে সর্বৈব ভুল কথাটির বড় একটা প্রতিবাদও ইদানীং করেন না— সেই কথাটিই আরও এক বার শোনাও হয়তো ‘গা-সওয়া’ মনে হত পারত, যদি এ বারের ‘বক্তা’র পরিচয়টি অগ্রাহ্য করা যেত। কিন্তু রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, সম্মাননীয় রাজ্যপালই এ কথা বললে তা আলাদা মাত্রা পায় বইকি। সম্প্রতি ব্রিগেডে লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে তিনি শুরুই করলেন এ কথা দিয়ে যে, তিনি চেষ্টা করবেন হিন্দিতে বলার, কেননা “হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রভাষা হল মা, আর ইংরেজি ধাত্রীমাতা; ধাত্রীমাতা কখনও মায়ের সমান হতে পারেন না।” বর্তমান ভারতশাসকদের হাতে হিন্দির অবিসংবাদিত গৌরব প্রতিষ্ঠার আবহে একটি রাজ্যের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদাধিকারীর এ-হেন মন্তব্যের গুরুত্ব সুদূরবিস্তারী— বিশেষত এমন এক রাজ্যে যা রাজনৈতিক বিচারে বিরোধী, যেখানকার মানুষ মুখ্যত কথা বলেন বাংলায়, ‌এবং যে বৈচিত্রসূত্রে বাংলা ও হিন্দির বনামতন্ত্র সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কেরও একটি মাপকাঠি।

গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে হঠাৎ হিন্দি-ইংরেজি তুলনা-প্রতিতুলনার দরকার পড়ল কেন, সেই আলোচনা সরিয়ে রেখে বরং এ রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার সেই কথাটি, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে এর আগে বহু বার যা লেখা হয়েছে: ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। এ শুধু এক তথ্য নয়, সত্য— দেশের সংবিধানেই যা লিপিবদ্ধ। অষ্টম তফসিল অনুযায়ী ভারতের আছে ২২টি ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’। স্বাধীনতা লাভের পরে ও সংবিধান প্রণয়নের আগে তৎকালীন সর্বদলীয় নেতারা ‘ন্যাশনাল’ নয়, ভারতরাষ্ট্র ও উচ্চ বিচারব্যবস্থার ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কে বসেন; তখনও ‘এক ভাষা এক লিপি’ ও সেই সূত্রে হিন্দির প্রধান মর্যাদার দাবি উঠেছিল বটে, তবে দক্ষিণ ভারতের প্রবল প্রতিবাদের মুখে তা ধোপে টেকেনি। ‘উত্তর ভারতীয়’, ‘হিন্দিভাষী’ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য— হিন্দিভাষী অঞ্চলগুলিই দেশের প্রাণকেন্দ্র, অন্যগুলি প্রান্তিক গুরুত্বের, এ শুধু এক ভুল ভাবনাই নয়, এক বিপজ্জনক ভাবনা; কোনও মানুষ বা গোষ্ঠীর উপরেই একটা ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলে না।

আজকের ভারতে বিজেপির ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’ প্রকল্প যে এই ভাবনার ধারেকাছেও আর নেই, তার প্রমাণ এখন রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে। হিন্দি হয়ে উঠেছে বর্তমান ভারতশাসকদের রাজনৈতিক বয়ান প্রচার-প্রসারের ভাষা, সেই বয়ানের গোড়ার কথাটিই হল এই ভুল ও মিথ্যার প্রচার— ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি, সুতরাং আর সব ভাষার উপরে এর স্থান। এই বয়ান এমন ভাবে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে যে জনমানসেও এই ভ্রান্ত ধারণা গেঁথে গেছে; জোসেফ গোয়েবলস-এর নামে আরোপিত সেই উদ্ধৃতিটি মনে পড়তে পারে— ‘মিথ্যা এক বার বললে তা মিথ্যাই থাকে, কিন্তু হাজার বার বললে তা-ই সত্য হয়ে ওঠে’। ‘হিন্দি রাষ্ট্রভাষা’, এই মিথ্যাটি এতদূর ছড়িয়েছে যে এখন রোজকার জীবনেও তা ফুটে বেরোচ্ছে— পশ্চিমবঙ্গে পথেঘাটে, গণপরিবহণে, ব্যাঙ্কে, রেলের কাউন্টারে, খেলার মাঠে, যে কোনও সামাজিক পরিসরে হিন্দি-সমর্থকদের তর্কের ভিত্তিপ্রস্তরই হল ‘হিন্দি রাষ্ট্রভাষা’ এই যুক্তি। তর্কের খাতিরে যদি এও ধরে নেওয়া যায় যে সাধারণ মানুষ সংবিধান নিয়ে তত ওয়াকিবহাল নন, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সেই ছাড় দেওয়া চলে কি? বিশেষত যে রাজনৈতিক মানুষরা দায়িত্বশীল পদে বিরাজমান? বিস্ময়কে ছাপিয়ে যায় শঙ্কা: এ কি স্রেফ অজ্ঞানতা, না কি জেনেবুঝেই বলা?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hindi Imposition Governor CV Ananda Bose geeta

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy