কূটনীতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের দুনিয়ায় কোনও চিরস্থায়ী শত্রু নেই; চিরস্থায়ী মিত্রও নয়— এই কথাটির সত্যতাকে প্রশ্ন না করেও বলা প্রয়োজন যে, আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চাইছেন বলেই চিনের সঙ্গে রাতারাতি সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে না। ফলে, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক ত্যাগ করে ভারত চিনের জাহাজে অর্থনীতির উত্তাল সাগর পাড়ি দেবে, এমন দিবাস্বপ্ন উগ্র জাতীয়তাবাদী ভক্তমহলের বাইরে আর কোথাও নেই। প্রথমত, বাণিজ্য-সম্পর্ক এক দিনে তৈরি হয় না। আমেরিকা ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যসঙ্গী, ভারতীয় রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার। সেখানে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। অন্য দিকে, চিনের সঙ্গে ভারতের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১০,০০০ কোটি ডলার। ব্রিকস-এর অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যের বহর আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের ধারেকাছেও নয়। অর্থাৎ, আজ চাইলেই আমেরিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে চিন ও তার সঙ্গী রাষ্ট্রগুলির মুখাপেক্ষী হওয়ার উপায় ভারতের নেই। সন্দেহ নেই, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের জন্য যে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তা আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতির দুনিয়ায় অতীব বেমানান। ভারত কোন দেশের সঙ্গে কী বাণিজ্য করবে, তা স্থির করার অধিকার অবশ্যই ভারতের। কিন্তু, বাস্তবকে অস্বীকার করারও কোনও অবকাশ নেই। শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশনের বৈঠকের ফাঁকে শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদীর সৌহার্দ-মুহূর্ত এবং ভারত-চিন সহযোগিতার সুভাষিতাবলির মধ্যেও সেই বাস্তবটি বিস্মৃত হওয়া বুদ্ধির কাজ নয়।
বাস্তবিক, চিনের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের পক্ষে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততখানিই কঠিন। দু’দেশের লক্ষ্য এক নয়, সামর্থ্যও তুলনীয় নয়। চিন আমেরিকার প্রতিস্পর্ধী দ্বিতীয় মেরু হয়ে উঠতে চেয়েছে— এবং বহুলাংশে সফলও হয়েছে। বাণিজ্যসঙ্গী হিসাবে তার কাছে ভারতের গুরুত্ব মূলত ভারতের বাজারের কারণে। সেই বাজারের চালিকাশক্তি ক্রেতাপিছু ক্রয়ক্ষমতা নয়, নিতান্তই বিপুল জনসংখ্যা। বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত চিনকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য যে আমেরিকারও নেই, তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্রম-নমনীয় অবস্থানেই স্পষ্ট। রাশিয়ারও চিন-নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে, শক্তির নিরিখে চিনের সঙ্গে সমানে-সমানে অংশীদারি করা ভারতের পক্ষে অসম্ভব। ভারত বাদে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে চিনের নিয়ন্ত্রণও প্রবল, এবং তা শুধু বাণিজ্যিক নয়— বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চিনের বিপুল ঋণ সে দেশগুলিকে চিনের নির্দেশ মানতে এক রকম বাধ্যই করে। ফলে সে বাজারের দখল পাওয়ার জন্য ভারত প্রয়াসী হতে পারে, কিন্তু তা সহজ হবে না।
অন্য দিকে, গত এক দশকে চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘাত অব্যাহত। চিন ক্রমশ আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে ভারতীয় সীমান্তে। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিও তার সমর্থনের শেষ প্রমাণ মিলেছে মাত্র চার মাস আগে। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সব প্রতিবেশী দেশেই এখন চিনের প্রভাব প্রবল। ভারতকে কোণঠাসা করে রাখার এই নীতি অকারণ নয়। এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক ভাবে চিনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার ক্ষমতা একমাত্র ভারতেরই আছে— ট্রাম্প-পূর্ব আমেরিকান প্রশাসন ভারতকে সে ভাবেই দেখেছে। ফলে, এশিয়া জুড়ে চিনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তার, এবং সেই সূত্রে কূটনৈতিক দুনিয়ার দ্বিতীয় মেরু হিসাবে অবিসংবাদী হয়ে ওঠার প্রকল্পের অন্যতম শর্ত ভারতকে নিরন্তর চাপে রাখা। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক মজবুততর করার পথে এই ভূ-রাজনৈতিক সত্যটি প্রধানতম বাধা। তাতে হাল ছাড়লে চলবে না, সম্পর্কের উন্নতিসাধনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে— কিন্তু, ভারত চাইছে বলে, অথবা ভারত এখনই চাইছে বলে চিনও তার পাশে দাঁড়াবে, শি জিনপিং-এর আপাতপ্রসন্ন মুখচ্ছবি সত্ত্বেও তেমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)