Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Sleeplessness

ঘুমপাড়ানি

ব্যাপার দেখে আদ্যিকালের ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মুখ বেঁকিয়ে হয়তো বলতেন, আদিখ্যেতা! দুটো কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, আর এক বাটা পান দিলেই কত দস্যি খোকার চোখে কত রাজ্যের ঘুম তাঁরা এনে দিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৫৯
Share: Save:

রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল? এই কথাগুলি আর নিরীহ কুশল প্রশ্ন নেই, এক সঙ্কটের ইঙ্গিত হয়ে উঠেছে। একবিংশ শতকের বিশ্বে অনিদ্রা প্রায় মহামারির আকার নিয়েছে। অতএব তার নিরসনও হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুবনজোড়া ব্যবসা। বাজার ছেয়ে ফেলেছে ঘুম-পাড়ানি নানা অ্যাপ। কোনও অ্যাপ মন শান্ত করার মন্ত্র আওড়ায়। কোনওটা নানা মন ভোলানো, কান জোড়ানো শব্দ শোনায়— জলের ছলছল, বাতাসের শনশন, বৃষ্টির ঝমঝম। ঘুম পাড়িয়েও যন্ত্রের কাজ শেষ হয় না, সে তখন ঘুম মাপতে থাকে। স্মার্ট ফোন কিংবা ডিজিটাল ঘড়িতে রাখা প্রযুক্তি নাকি পড়ে নিতে পারে ঘুমের গভীরতা— কখন স্বপ্ন-দেখা হালকা ঘুমের পর্ব চলছে, আর কখন সুষুপ্তি, সব রেকর্ড করে রাখে। ঘুম ভাঙার পক্ষে যখন সুসময়, তখনই অ্যালার্ম বেজে ওঠে। ফলে শরীর-মন থাকে ঝরঝরে, সারা দিন ঘুম-ঘুম ভাব থেকে রেহাই মেলে। মনে পড়ে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের সেই প্রতিহিংসা-পরায়ণ কেরানিকে, যিনি অবসর নেওয়ার পরের দিন ভোরে অ্যালার্ম বাজতেই নৃশংস ভাবে পিটিয়ে শেষ করেছিলেন ঘড়িটাকে। এখন ঘড়ির স্বৈরতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করার দরকার নেই কারও। ঘড়ি কাঁচা ঘুম ভাঙাবে না আর, ঘুমই ভেঙে এসে বাজাবে ঘড়িকে। অবশ্য এমন সব বাণিজ্যিক দাবিতে কতটা জল মেশানো থাকে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি আমেরিকার এক দৈনিকের নিয়মিত লেখক দাবি করেছেন, তিনি পর পর চার রাত অসুস্থ পোষ্যের সেবা করতে মাঝরাতে জেগেছেন, কিন্তু প্রতি দিনই সকালে এক বৃহৎ সংস্থার ডিজিটাল অ্যালার্ম ঘড়ি তাঁকে ‘অতি উত্তম’ ঘুমের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। তবু বিশ্ব জুড়ে এমন নানা প্রযুক্তির শরণাগত হচ্ছেন অনিদ্রায়, বা মন্দ নিদ্রায় কষ্ট-পাওয়া মানুষেরা। কেবল আমেরিকাতেই নাকি তেমন দুর্ভাগার সংখ্যা অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ, বলছে একটি সমীক্ষা।

অর্থাৎ ভাগ্যের চাকা ঘুরছে। যাঁরা ঘুমকাতুরে, তাঁরা এত কাল শুনে এসেছেন যে, তাঁরা অলস, নিষ্কর্মা। এখন তাঁদের পোয়াবারো। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও কোনও অসুখে ভুগলে কারও কারও বেশি ঘুম হতে পারে, তা বলে বেশি ঘুমালে কারও অসুখ করে না। বরং কম ঘুমালেই অসুখ বাধার সম্ভাবনা প্রবল— যে সব অসুখ সর্বাধিক মৃত্যুর কারণ হয়, সেগুলির অন্তত অর্ধেকের সঙ্গে নিদ্রায় ব্যাঘাতের সম্পর্ক রয়েছে। গভীর ঘুমের পর্যায়ে স্নায়ু বিশ্রাম না পেলে ব্যথা-বেদনাও সারতে চায় না। সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুমের প্রয়োজন নিয়ে সকলকে সচেতন করতে প্রতি বছর মার্চ মাসে একটি দিন ‘বিশ্ব নিদ্রা দিবস’ বলে পালিত হয়। অতএব ‘কাজ নেই বলে ঘুমোচ্ছে’, এমন অপবাদ আর দেওয়া চলে না। এখন ঘুমোনোই একটা দরকারি কাজ। তাই ঘুমের জন্য চলে কত না প্রস্তুতি— সন্ধ্যার পর কফি বন্ধ, ঘুমের ঘণ্টাখানেক আগে থেকে টিভি কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখা চলবে না, রাতে জলদি ডিনার, সন্ধ্যা থেকে স্তিমিত আলো। মনকে নিরুদ্বেগ করতে মেডিটেশন। আসক্তি বা অভ্যাস তৈরি না করে ঘুমোতে সাহায্য করে যে ‘মেলাটোনিন’ ওষুধ, তার বাজার বিশ্বে ৩৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, এবং দ্রুত বাড়ছে।

ব্যাপার দেখে আদ্যিকালের ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মুখ বেঁকিয়ে হয়তো বলতেন, আদিখ্যেতা! দুটো কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, আর এক বাটা পান দিলেই কত দস্যি খোকার চোখে কত রাজ্যের ঘুম তাঁরা এনে দিয়েছেন। আর এখন কানে চাট্টি হুশহুশে হাওয়ার শব্দ, আর গোলমেলে মাপজোক দেখিয়ে সাত ভূতে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটছে। সত্যি, এমন ঘুম-বিপণন অবাক করে। খাওয়া আর ঘুম, দুটোই একান্ত জৈবিক প্রক্রিয়া, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক ছন্দে হওয়ার কথা। কিন্তু আধুনিক জীবনে বহু মানুষের কাছে এ দুটো কাজই হয়ে উঠেছে রীতিমতো ‘প্রজেক্ট’। অতিশয় হিসাব কষে আহারের আয়োজন, আর অতিশয় তোড়জোড় করে ঘুমের আবাহন, এই হল আধুনিক জীবনচর্যার অভিজ্ঞান। প্রতি মুহূর্তে মাপজোক করে চলে অ্যাপ— কত ক্যালরি খাওয়া হল, কত পা হাঁটা হল, আর তাতে কতখানি মেদ ক্ষয় হল, কত ক্ষণ গভীর ঘুম হল, আর কত ক্ষণ স্বপ্ন-দেখা চঞ্চল-চোখ ঘুম। এ সবই হয়তো শেষ বিচারে নিজের জীবনে নিজের নিয়ন্ত্রণ ফেরানোর চেষ্টা। অতিরিক্ত কাজ, অপরিমিত বিনোদন, অশেষ উৎকণ্ঠা— একুশ শতকের নাগরিক জীবনে কে-ই বা এ সব এড়াতে পারে? দেহ-মন যখন বেসামাল, তখন অ্যাপ আশ্বাস দেয়, তিন ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিট তেরো সেকেন্ড গভীর ঘুম হয়েছিল কাল রাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sleeplessness Insomnia unhealthy habits
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE