একেবারে গোড়ায় বলা দরকার, এবং সজোরে বলা দরকার— রাজনীতির মঞ্চ থেকে যে কোনও মহিলা সম্বন্ধে কটূক্তি অন্যায়, নিন্দনীয়; তা তিনি কারও মা হোন বা না-ই হোন। বিহারে ভোটার অধিকার যাত্রার মঞ্চ থেকে যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মা সংক্রান্ত কটূক্তি করেছিলেন, তাঁকে ধিক্কার। দুর্ভাগ্য— সেই মঞ্চের নেতা হিসাবে যাঁরা সে দিন ছিলেন, রাহুল গান্ধী বা তেজস্বী যাদব এই মন্তব্য নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের অন্যায় রাজনীতির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেও স্পষ্টত বলেননি যে মন্তব্যটির দায় মন্তব্যকারীকেই নিতে হবে। তবে একই সঙ্গে এ আরও বড় দুর্ভাগ্য যে, এই সুযোগে বিজেপি আবারও কদর্য রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, অথচ মন্তব্যটি যে রাহুল বা তেজস্বীর নয়, তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। সুতরাং, কারও সন্দেহ হতেই পারে যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল জেনেবুঝেই ‘মায়ের অপমান’-কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। বাস্তবিক, ভারতীয় রাজনীতির হাল এখন এমনই নিম্নগামী যে নিকৃষ্ট নারীবিদ্বেষী মন্তব্যকেও রাজনৈতিক মুদ্রা হিসাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করা চলে। এবং প্রধানমন্ত্রী বা সাংসদ বা রাজনৈতিক নেতারা অনায়াসে দুর্বাক্য এবং দুরাচারকে রাজনীতির মধ্যে এতখানি গুরুত্ব দেন। এখানে কোনও শাসক-বিরোধী ভেদাভেদ চলতে পারে না, যে কোনও পক্ষে যে কেউ এমন কাজ করলেই তা সপাট নিন্দাযোগ্য।
বিষয়টি আসলে একটি ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। মহিলাদের অপমান ভারতীয় রাজনীতির কতখানি প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে, তা বোঝার জন্য কিছু অনতি-পুরনো কথা প্রাসঙ্গিক। বিরোধী দলনেতার মা সম্বন্ধেও শাসকরা (বহুবচন বটে, কিন্তু তাতে একবচনের ভূমিকাটি অবিস্মরণীয়) অশোভন কথা বলেছেন বহু বার, যা শুনে একই ভাবে লজ্জিত কুপিত হয়েছেন ভারতীয় নাগরিক। বিপক্ষ দলের সাংসদের স্ত্রী সম্বন্ধে মন্তব্যও এখনও জনস্মৃতিতে উজ্জ্বল। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে একটি বিশেষ সুরে ‘দিদি, ও দিদি’ বলে যে আওয়াজ বারংবার ধ্বনিত হয়েছিল, সে কেবল অশোভন ছিল না, অপমানজনক ছিল। কোনও মহিলার উদ্দেশে ওই ভঙ্গিতে আওয়াজ করাকে সভ্য সমাজ তাকে ‘ইভ টিজ়িং’ হিসাবেই চিহ্নিত করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, তাঁর দলের মেজো-সেজো নেতারা মহিলাদের সম্বন্ধে হরহামেশা কেমন অবমাননাকর উক্তি করেই থাকেন; ধর্ষণে অভিযুক্ত নেতা জামিন পেলে তাঁকে জয়মালায় বরণ করে বিজয়মিছিল বার করে তাঁর দলের সমর্থকরা। জেএনইউ-এর ছাত্র নাজিব আহমেদের মায়ের মুখও কি তাঁর বা তাঁদের মনে পড়বে না— ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে দরজায় দরজায় মাথা ঠুকে মরেছেন যিনি, অথচ প্রশাসনের সামান্যতম সহানুভূতিও জোটেনি তাঁর?
প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজের মায়ের অপমানকে দেশের সব মায়ের অপমান বলে চিহ্নিত করেছেন। সত্য কথা— এক নারীর অপমান মানেই সব নারীর অপমান। তবে সর্ব ক্ষেত্রেই তা সমান ভাবে প্রযোজ্য হওয়া দরকার, শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে। ভারতীয় রাজনীতিতে নারীর সম্মান ক্রমশই ধুলোয় মিশছে। এই ক্রমাগত অবনমনরেখার পিছনে সব দলেরই অবদান প্রভূত, কিন্তু তন্মধ্যেও বিজেপির রেকর্ডটি অসহনীয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)