E-Paper

বিপন্নতার ছবি

বহু এলাকায় নাবালক পাচারের চক্র চলছে। অতীতে তামিলনাড়ুর সোনার গয়নার কারখানা থেকে উদ্ধার হয়েছে পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার শিশুরা। এদের অনেকেই ‘দাসশ্রমিক’ অবস্থায় ছিল বলে ক্ষতিপূরণও পেয়েছে কেন্দ্রের থেকে।

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:১৬

একটি ছবিই যে সহস্র কথা বলে দিতে পারে, তা ফের বুঝিয়ে দিল শিশু দিবসে প্রকাশিত একটি আলোকচিত্র। তমলুকের একটি ইটভাটায় এক শিশুকে ধরে রয়েছে আর এক শিশু। চার-পাঁচ বছরের কন্যার যেখানে নিজেরই আদরযত্ন পাওয়ার কথা, সেখানে সে হয়ে উঠেছে পরিচর্যাকারী দিদি। এই চিত্র অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মেয়েদের পরিবারে অতি পরিচিত। ইটভাটাগুলিতে তো কর্মীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার কোনও হদিস মেলাই কঠিন— কর্মীদের একটি বড় সংখ্যা নারী এবং শিশু, কিন্তু সুরক্ষার কোনও বিধিনিয়মই ভাটাগুলির চৌকাঠ পেরোতে পারে না। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও ছবিটা খুব আলাদা নয়। খেতমজুর-মহিলা থেকে নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলা, কারও শিশুসন্তানের জন্যেই পরিচর্যার ব্যবস্থা নেই। ভরসা বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা, না হলে একটু বড় সন্তান, সাধারণত কন্যাসন্তানটি। খাতায়-কলমে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের অঙ্গনওয়াড়িতে দিনের কিছুটা সময় থাকার কথা। কিন্তু রাজ্যের কতগুলি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুরা বাস্তবিক প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা, সুষম খাদ্য এবং পরিচর্যা পায়, সে প্রশ্ন করলে হতাশ হতে হবে। অধিকাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র কেবল খিচুড়ি বিতরণ কেন্দ্র হয়ে রয়েছে, প্রচুর কর্মীর পদ শূন্য। কর্নাটকে পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে দুপুরে ক্রেশ চলে। হরিয়ানায় রাজ্য সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর ক্রেশ চালাচ্ছে, ওড়িশা এবং কেরলেও সরকার এবং অসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে নানা জায়গায় ক্রেশ চলছে। পশ্চিমবঙ্গে তেমন প্রকল্প দূরে থাক, কোনও পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না। সংগঠিত ক্ষেত্রেও ছবিটি আশাজনক নয়— রাজ্যের আঠারো হাজার কলকারখানার একটিতেও ক্রেশ নেই। অথচ, কর্মরত মায়েদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য ক্রেশের বন্দোবস্ত রয়েছে একাধিক আইনে। কেন্দ্রীয় বাজেটে তার জন্য টাকাও বরাদ্দ হয়।

কর্মস্থলে অথবা বাসস্থানের কাছাকাছি ক্রেশ, স্কুলগুলিতে হস্টেল— পরিচর্যার এই ধরনের পরিকাঠামো না থাকার জন্য এ রাজ্যের শিশু, কিশোর-কিশোরীরা কতখানি বিপন্ন হচ্ছে, তার প্রতিফলন মিলছে শিক্ষা, পুষ্টির লজ্জাজনক পরিসংখ্যানে। রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে, আরও বেশি মহিলা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এই সব পরিবারের সন্তানদের দৈনন্দিন পরিচর্যার, স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য সহায়ক ব্যবস্থা কিছুই গড়ে উঠছে না। কিশোরদের স্কুলছুট হওয়া, অন্য রাজ্যে কাজ করতে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। নিজের পরিবার-পরিজনের থেকে দূরে, ভিন রাজ্যে অপরিচিত মানুষদের মধ্যে পড়ে একটি শিশু কতখানি বিপন্ন হয়ে পড়ে, তার সংবাদ সম্প্রতি মিলেছে পূর্ব বর্ধমানের কালনা থেকে। সুলতানপুর পঞ্চায়েতের বারো বছরের কিশোর সুরাতে নকল গয়না তৈরির কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ফিরেছে সারা পিঠে কালশিটে নিয়ে। মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতির জায়গায় কার্যত বন্দিদশায় দিনগুজরান, লোহার রড দিয়ে মারধর: খেতমজুর পরিবারের এই বালকের অভিজ্ঞতা।

বহু এলাকায় নাবালক পাচারের চক্র চলছে। অতীতে তামিলনাড়ুর সোনার গয়নার কারখানা থেকে উদ্ধার হয়েছে পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার শিশুরা। এদের অনেকেই ‘দাসশ্রমিক’ অবস্থায় ছিল বলে ক্ষতিপূরণও পেয়েছে কেন্দ্রের থেকে। স্কুলছুট শিশুকে কাজে পাঠানোর জন্য, নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার জন্য দরিদ্র পরিবারকে দোষী ঠাহর করা সহজ। কিন্তু বাস্তব এই যে, অতিদরিদ্র, শ্রমজীবী পরিবারের শিশুদের পুষ্টি, শিক্ষা, সুরক্ষার অভাবে অপুষ্টি, অশিক্ষার চক্র চলতেই থাকবে। শিশুর জন্য বিনিয়োগের মাত্রা বাড়াতে হবে, পরিচর্যার পরিকাঠামো গঠন করতে হবে। নতুবা এক শিশুর উপর অন্য শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব চাপানোর বাস্তব চলবেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Children child

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy