নিহত সাবির মল্লিক।
অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও কি নিঃশব্দে নীরব থেকে যাচ্ছে এই দেশ, দেশবাসী? এক ঐতিহাসিক জন-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন এখন অতি প্রাসঙ্গিক, যদিও সংশয় হয়, প্রশ্নের বৃত্তটা যত বড় হওয়া দরকার, এখনও তা ঘটতে অনেকটা বাকি। বাইশ বছরের সাবির মল্লিকের কথা নতুবা এত কম ধ্বনিত হত না। সাবির এক দরিদ্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, হরিয়ানায় এসেছিল কাজ করতে। গোমাংস রান্নার সন্দেহে গণপিটুনিতে তার প্রাণ গেল, ঘরে পড়ে রইল স্ত্রী ও এক শিশু। এ যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এত দিনে বহু বার তা প্রমাণিত। বাস্তবিক, সাবির মল্লিক হত্যার কয়েক দিন আগেই হরিয়ানাতেই ফরিদাবাদের কাছে উনিশ বছরের আরিয়ান মিশ্রকে মুসলমান সন্দেহে খুন করা হয়েছে। এই সদ্যতরুণকে ৪০ কিলোমিটার গাড়িতে ধাওয়া করে পশুশিকারের মতো গুলি করে মারা হয়েছে, যে ঘটনার বিবরণ গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেয়।অবশ্য আদৌ কত মানুষের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, বোঝা দায়, কেননা দু’টি ঘটনার কোনওটিতেই তেমন আন্দোলিত হতে দেখা গেল না বৃহত্তর ভারতীয় জনসমাজকে। মনে করা যেতে পারে, এই সব সংবাদ এখন পুরনো এবং/ সুতরাং গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। দেশ জুড়ে একের পর এক প্রাণ এই ভাবে চলে যাচ্ছে গোমাংস-ভক্ষক কিংবা মুসলমান ‘সন্দেহ’মাত্রে— এই বাস্তবই বুঝিয়ে দিতে পারে যে, যাঁরা এ দেশে সত্যিই সংখ্যালঘু হিসাবে জীবনধারণ করেন, যাঁদের আহারে ঐতিহ্যগত ভাবেই গোমাংস থাকার কথা, তাঁদের পরিস্থিতি এখন ঠিক কী ও কেমন দাঁড়িয়েছে। জনসমাজের অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য বুঝিয়ে দেয় যে, তাঁদের পরিস্থিতি এখন যেমনই হোক না কেন, ভারতে এখন তা বেশ স্বাভাবিক ও সহনযোগ্য ঘটনা।
গোরক্ষার নামে দেশজোড়া তাণ্ডব যে অবলীলায় ও প্রায় বিনা প্রতিবাদে সংঘটিত হয়ে চলেছে, তার পিছনে ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দলটির সংযোগ কেবল স্পষ্ট নয়, বিজেপির নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও রীতিমতো প্রত্যক্ষগোচর। মনে করা যেতে পারে, এই অপরাধে অভিযুক্ত নেতা ২০১৬ সালে পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৮ সালে পঁয়তাল্লিশ বছরের মুসলমান গোমাংস বিক্রেতাকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলেছে যে আট দুষ্কৃতী, তাদের বিজেপি মন্ত্রী এসে নিজের হাতে মালা পরিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। গোরক্ষক দল বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে প্রকাশ্যে বন্দুক নিয়ে তাদের টহল জারি রাখলে সে সব রাজ্যের প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এই ধরনের হত্যায় বা তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সে সব রাজ্যের পুলিশকর্মীরা সক্রিয় ভাবে গোরক্ষকদের সহায়তা করেছেন। নিঃশব্দে নীরবে বয়ে গিয়েছে ভারতগঙ্গা।
নীরবতা ভাঙার প্রথম ও প্রধান যে উপাদানের নাম অপরের জন্য ‘সংবেদন’, আজকের প্রবল আন্দোলিত পশ্চিমবঙ্গে সে কথা নতুন বিভায় উজ্জ্বল। অন্যায়, অনৈতিকতা, দুর্নীতি এবং সংগঠিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে এতখানি নাগরিক সংবেদনশীলতার পরিচয় স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে এই দেশ দেখেনি, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। এ দিক দিয়ে গোটা দেশেই ইতিমধ্যে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে এই রাজ্য। তবে কিনা, গৌরবের সঙ্গে সঙ্গে, এই মুহূর্ত কিন্তু আরও এক বার আত্মমন্থনের সুযোগও এনে দিয়েছে। সংবেদন তৈরির আবশ্যিক উপাদান হচ্ছে নিজের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করা। তাই, রাজনৈতিক ও সামাজিক দুরাচারের অন্য দিকে যখন প্রান্তিক, দরিদ্র, সংখ্যালঘু মানুষ, তখন তার সঙ্গে সমাজের মূলস্রোত যথেষ্ট সংযোগ বোধ করছে কি না, সেটাও ফিরে ভাবার বিষয় বইকি। এখানেও হয়তো আজ একটি নতুন সুযোগ— ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-জাত ও প্রাদেশিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের অধিকার, সম্মান ও স্বাধীনতার পক্ষে একটি রাজনীতি তৈরি করে দেশকে পথ দেখানোর, আরও দৃষ্টান্ত তৈরি করার। পশ্চিমবঙ্গ ভেবে দেখতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy