E-Paper

বিতর্ক স্বাগত

সর্বোচ্চ সাজা বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সামাজিক বিতর্ক চলুক, এটাই কাম্য।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:০৯

সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষেত্রে এখনও ‘ফাঁসি’ দেওয়াই একমাত্র সমাধান কি না, সেই ভাবনাতেও পরিবর্তন এলে ভাল। অথচ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা গেল, কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে রীতিমতো অনমনীয়। মামলার বিষয় ছিল, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মারণ ইনজেকশন দেওয়া যায় কি না। ফাঁসি, না ইনজেকশন— চরম সাজা হিসাবে তাঁরা কোন বিকল্প বেছে নিতে চান, সেই অধিকারটি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের থাকা উচিত কি না। সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে সরকারের পরিবর্তনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পক্ষপাতী। কিন্তু সরকারি হলফনামাতে দণ্ডিতকে এমন কোনও বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলেই জানানো হয়েছে।

আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির দাবিতে যখন পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল, সেই আবহে কলকাতা হাই কোর্টের জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চ একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বহুশ্রুত কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছিল আমাদের— প্রতিশোধের কথা ভেবে নয়, সংস্কারের কথা ভেবে সাজা দিতে হবে। অপরাধীকে নয়, অপরাধকে ঘৃণা করতে হবে। চরম অপরাধের ক্ষেত্রেও সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের প্রথাটি পুরোপুরি উঠে গিয়েছে বিশ্বের ১১২টি দেশ থেকে। কিন্তু চিন, ইরান, সৌদি আরব, আমেরিকার পাশাপাশি ভারতে এখনও মৃত্যুদণ্ড থেকে গিয়েছে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রে। মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে অপরাধ হ্রাসের সম্পর্কটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক থেকেছে। ভারতের আইন কমিশনের ৩৫তম রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়— এই মতবাদে সত্যতা আছে। যদিও এই একই রিপোর্টে নানা দেশের তথ্য-পরিসংখ্যানের পরস্পর-বিরোধিতার কথাটিও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালের আইন কমিশন কিন্তু স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সমাজে বাড়তি কোনও সুফল হয় না। তারা মৃত্যুদণ্ড বিলোপের প্রস্তাব করেছিল। দৃশ্যতই ভারত সরকার সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

অতঃপর মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প হিসাবে শাস্তির যে প্রস্তাবগুলি করা হয়েছে, যেমন আমৃত্যু কারাদণ্ড, ভারতের মতো সুবিশাল এবং দরিদ্র দেশে তার পরিকাঠামো গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য— মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে এমন যুক্তিও উঠে আসে। কিন্তু কষ্টকর বলেই মধ্যযুগীয় এক প্রথাকে বছরের পর বছর লালন করা হবে? ব্যতিক্রম হিসাবে মৃত্যুদণ্ডকে রেখে দেওয়া হলেও তার পদ্ধতিটি নিয়ে অবশ্যই অবিলম্বে চিন্তা করা জরুরি। সব নাগরিকেরই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণের অধিকার থাকে, অন্তত তত্ত্বগত ভাবে এ কথা রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তিম ক্ষণগুলি তিনি নিজেই নির্ধারণ করবেন— মানবিক রাষ্ট্রের এমনটাই ভাবা উচিত। ফাঁসির পদ্ধতিটি দীর্ঘ, চরম যন্ত্রণাদায়কও। এ দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের গৃহীত প্রস্তাব— মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ যেন ন্যূনতম যন্ত্রণার হয়। বিকল্প হিসাবে ফায়ারিং স্কোয়াড এবং গ্যাস চেম্বারও যথেষ্ট ভীতিপ্রদ। সে দিক থেকে মারণ ইনজেকশন অনেক বেশি মানবিক এবং শালীন ভাবে কার্যকর করা সম্ভব। সুপ্রিম কোর্টে আবেদনকারীরাও সেই কথাই বলেছেন। সর্বোচ্চ সাজা বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সামাজিক বিতর্ক চলুক, এটাই কাম্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

debate Law

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy