এক রাশ চাপের মাঝে সাময়িক স্বস্তি। গত সেপ্টেম্বরে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহারে ভারতের উপরে যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন, আগামী ছ’মাসের জন্য তা তুলে নিল তারা। ওই সময় আমেরিকার ঘোষণা, তারা ইরান ফ্রিডম অ্যান্ড কাউন্টার-প্রলিফারেশন অ্যাক্ট (আইএফসিএ)-এর অধীনে ইরানের চাবাহার বন্দর নিয়ে ২০১৮ সালে প্রদত্ত ছাড় প্রত্যাহার করছে। পরমাণু চুক্তি নিয়ে সম্পর্কের অবনতির জেরে ইরানি সরকারকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে এ-হেন পদক্ষেপকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বোচ্চ চাপ নীতির অংশ হিসেবেই দাবি করে সে দেশের বিদেশ মন্ত্রক। ছাড়ের মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে আমেরিকার জরিমানার তাৎক্ষণিক ঝুঁকি ছাড়াই ভারত বন্দর কার্যক্রম, পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং মানবিক পণ্য পরিবহণ চালিয়ে যেতে পারবে। লক্ষণীয়, মেয়াদ বৃদ্ধির কথাটি ঘোষিত হল এমন সময়ে যখন দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত রফা চলছে। এ দিকে, মকুবটি ভারতের ক্ষেত্রে একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমেরিকা যত বারই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনা করেছে, তত বারই শিরোনামে এসেছে চাবাহারের নাম— এ-হেন স্মারক হিসেবে যে ভূরাজনীতিতে সমুদ্রও নিরপেক্ষ নয়।
পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের একমাত্র সরাসরি সমুদ্র সংযোগ হল চাবাহার। ওমান উপসাগরে অবস্থিত বন্দরটি ভারতের ক্ষেত্রে শুধু ভ্রমণের সময় এবং পরিবহণ খরচই হ্রাস করে না, উজ়বেকিস্তান এবং কাজ়াখস্তানের মতো স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রগুলির বাজারের সঙ্গে স্বতন্ত্র সংযোগের ক্ষেত্রেও সহায়তা করে। তা ছাড়া, কৌশলগত ভাবেও চাবাহারকে কার্যকর রাখা ভারতের ক্ষেত্রে জরুরি। ভুললে চলবে না, তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে গ্বদর বন্দর গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে চিন, যা ভৌগোলিক ভাবে চাবাহারের কাছাকাছি। ফলে, চাবাহারের মাধ্যমে ইরানে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখা ছাড়াও আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও সম্প্রসারণের সুযোগ থাকছে ভারতের কাছে। বন্দরটি ইরানের মাধ্যমে মুম্বইকে রাশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করার ভারতের বৃহত্তর আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডর (আইএনএসটিসি) পরিকল্পনার সঙ্গেও খাপ খায়, যা বহু বাণিজ্য-পথকেই সংক্ষিপ্ত করবে। তাই, চাবাহার হাতছাড়া হলে তাতে কেবল ভারতের বাণিজ্য পথই দুর্বল হবে না, আরব সাগর এবং মধ্য এশিয়া জুড়ে বেজিংয়ের প্রভাব বিস্তারের একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্রও তৈরি করবে।
চাবাহারের উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে লাগাতার আলোচনা চালিয়ে গিয়েছে দিল্লি। এমতাবস্থায় এই রদের ঘোষণাকে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেও দেখছেন অনেকে। তবে এই মেয়াদ বৃদ্ধি সাময়িক। ভারতকে তার বিনিয়োগ রক্ষা করতে, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার জন্য চাপ দিতে এই অতিরিক্ত সময়টি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের ক্ষেত্রে ধৈর্য জরুরি, তবে অস্থির বৈশ্বিক পরিবেশে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এবং বাহ্যিক চাপের সামনে খুব নিষ্ক্রিয় বা ধীরও হওয়া চলে না। আগামী দিনে ওয়াশিংটনের কাছে দিল্লিকে কী মূল্য চোকাতে হয়, সময়ই তা বলবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)