E-Paper

অপচয়-শ্রী

পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে দৈনিক মজুরি পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি, দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীর চাহিদাও সেখানে বাংলার থেকে বেশি।

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২৫ ০৮:১০

পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে এলে ‘শ্রমশ্রী’ ভাতা পাবেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঘোষণা সঙ্কটের সমাধান না করে, তাতে এক বাড়তি মাত্রা যোগ করল। রাজ্যে ফেরার পথখরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা, এবং রাজ্যে কোনও কাজে নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেবে রাজ্য সরকার, এই প্রস্তাব কেবল অপচয়ী নয়, অনুচিত। অর্থনীতি বা রাজনীতি, কোনও দিক থেকেই এর সমর্থনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক ভাবে, বাংলার বিপুল পরিযায়ী শ্রমবাহিনীকে রাজ্যের মধ্যে যথেষ্ট অর্থকরী কাজ দেওয়া যাবে সরকারি প্রকল্পে— এ এক অসম্ভব কল্পনা। পরিযায়ী শ্রমিকরাও এই বিকল্পকে প্রত্যাখ্যান করছেন। আক্রান্ত শ্রমিকরা ঘরে ফিরে আসার অব্যবহিত পরেই ফের অন্য রাজ্যে কাজে যাচ্ছেন। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে দৈনিক মজুরি পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি, দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীর চাহিদাও সেখানে বাংলার থেকে বেশি। কাজের বাজারের নিয়ম মেনেই নানা রাজ্যের মধ্যে শ্রম-পরিযাণ ঘটছে। বাইশ লক্ষ শ্রমিক সরকারি পোর্টালে নথিভুক্ত হলেও পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক কাজের সন্ধানে বাইরে যান। সে চিত্র কি পরিবর্তন করা যাবে করদাতার টাকার বিপুল অপচয়ের মাধ্যমে? মেলা-খেলা, অনুদান-ভর্তুকির নানা প্রকল্পের মতো, ‘শ্রমশ্রী’-র ক্ষেত্রেও টাকার খরচ ও তার ফলাফলের হিসাব পাওয়া দুঃসাধ্য হবে। একশো দিনের কাজের ভুয়ো জব কার্ড, আবাস যোজনার ভুয়ো ঘর-প্রাপক, এমএসপি-এ ধান বিক্রি করা ভুয়ো চাষির মতো, ভুয়ো পরিযায়ীতে রাজ্য ভরে যাবে, তার আশঙ্কা যথেষ্ট। ‘শ্রমশ্রী’ পোর্টালে নাম নথিভুক্তির জন্য দালালদের উদয় হবে, সে-ও প্রায় অবধারিত। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এমন এক প্রকল্পে উন্নয়নের টাকা ঘুরপথে দলীয় রাজনীতিতে টেনে আনারই কি ব্যবস্থা হচ্ছে?

তবে প্রধান আপত্তিটি রাজনীতির। ভাষা-সন্ত্রাসের সঙ্কট আদ্যন্ত রাজনৈতিক— বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি পরিযায়ীর উপর পুলিশ-আধিকারিকদের ভাষা-সন্ত্রাস আসলে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ভোট পাওয়ার নিষ্ঠুর কৌশল। কিন্তু তার উত্তরে মমতা যে অবস্থান নিলেন, সে-ও এক অপরিণামদর্শী, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির পরিচয় বহন করছে। শ্রমিকদের ঘরে ফেরার জন্য রাজকোষ থেকে টাকা জুগিয়ে তিনি এই বার্তাই দিচ্ছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাঙালি শ্রমিক সুরক্ষিত নন। প্রাণে বাঁচতে হলে তাঁকে রাজ্যেই ফিরতে হবে, এবং সরকারের ভাতা নিয়ে, অথবা সরকারি প্রকল্পের কাজ করে খুশি থাকতে হবে। হরিয়ানা বা ওড়িশায় ভাষা-সন্ত্রাসীরা বোঝাতে চেয়েছে বাঙালিমাত্রেই ‘অনুপ্রবেশকারী’, অন্য রাজ্যে কাজ করার অধিকার নেই। মমতা পরিযায়ীদের ফিরে আসতে বলে প্রকারান্তরে সেই মনোভাবকে সমর্থন করছেন না কি? বাঙালি-বিদ্বেষের প্রত্যুত্তর বাঙালির অপসারণ হতে পারে না। বাঙালিকে স্বমর্যাদায়, স্বাধিকারের সঙ্গে দেশের সর্বত্র সুরক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার লড়াইটাই আজ বাংলার রাজনৈতিক লড়াই। মারের ভয়ে বাঙালি ঘরে ফিরে এলে, আজ দরিদ্র শ্রমিকদের যারা আক্রমণ করছে, কাল তারাই খাঁড়া তুলবে বাঙালি পর্যটক, ছাত্রছাত্রী, চাকুরে-ব্যবসায়ীদের উপর। পক্ষিমাতা সাজার সময় এটা নয়।

এই সম্ভাব্য বিপদগুলি নিয়ে আলোচনার আগেই ‘শ্রমশ্রী’ ঘোষিত হয়ে গেল। করদাতার টাকা খরচের মাধ্যমে রাজ্যবাসীর ভাগ্য নির্ধারণের গুরুতর সিদ্ধান্তগুলি নেত্রীর ‘মর্জি’ থেকে ‘নীতি’ হয়ে যাচ্ছে বিচার-বিবেচনা কিংবা গণতান্ত্রিক মতে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। বিধানসভার বিতর্ক বস্তুটি তো রাজ্যবাসী ভুলতেই বসেছেন। তবুও ‘শ্রমশ্রী’-র পরিকল্পনার পর্বে পরিযায়ীদের নিয়ে কর্মরত শ্রমিক সংগঠন, সমাজকর্মীদের মতামত জানানোর সুযোগ কি রাজ্য সরকার দিতে পারত না? গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীনকে সংযত, সংশোধন করার যে ব্যবস্থাগুলি রয়েছে, সেগুলি লুপ্ত হতে বসেছে। তাই জনস্বার্থ ছোট হয়ে যাচ্ছে দলীয় স্বার্থের কাছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

migrant labour Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy