পুজো আসার প্রতীক, অর্থাৎ কাশফুল, সাদা মেঘ বা শারদ সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির যতখানি আকুলতা, উৎসব বিদায়ের চিহ্নগুলি নিয়ে তার ততখানি ভাবনা দেখা যায়
না। কারণ, যত্রতত্র আবর্জনা, ঢিবি হয়ে থাকা উচ্ছিষ্টবহুল থার্মোকলের পাত্র ও বাসি ফুলের অবশিষ্ট-সহ প্লাস্টিকের প্যাকেট, গাছের ভাঙা ডাল, ছিঁড়ে পড়া ব্যানার, রাস্তায় মণ্ডপের ক্ষত— এগুলিই তার পুজো শেষের চিহ্ন। প্রতি বছর উৎসবের ধুমধাম যত বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে পরিবেশের উপর ক্ষয়ক্ষতির খাজনা। শারদীয় দূষণচিত্রে এ বারের সংযোজন পক্ষিকুলের বিপন্নতা। শীতদেশীয় পরিযায়ীদের পথপ্রদর্শক ঝাঁকটি এই সময়েই ক্রান্তীয় অঞ্চলের আশ্রয়স্থলগুলি জরিপ করতে আসে। তারাদের দেখে আকাশপথে চলতে তাদের বাধা দিচ্ছে মণ্ডপ থেকে ছোড়া লেজ়ার রশ্মি। উৎসবের জন্য গাছপালা ছাঁটা, থাকা-বসার জায়গা নেই। ফলে, পরিযায়ীরা শহর এড়াতে শুরু করছে। পুজোর চোখ-ধাঁধানো কৃত্রিম আলোর প্রতাপে ফুলের পাপড়ি খুলছে না। সঙ্কটে পেঁচা, রাতচরা প্রভৃতি নিশাচর।
কিছু মানুষের আনন্দের জোগান দিতে শুধু বহু লোকেরই অসুবিধা নয়, গোটা বাস্তুতন্ত্রকে সমস্যায় ফেলাই যেন উৎসবের রেওয়াজ। উৎসব মরসুমের প্রায় দু’-আড়াই মাস ধরে গাছ কেটে, পার্ক, মাঠঘাট দখল করে মণ্ডপ বানিয়ে, আলো ও শব্দের দাপাদাপির মাধ্যমে শুধু বৃক্ষজগৎ বা পক্ষিসমাজই নয়, কুকুর, বিড়াল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি গোটা আঞ্চলিক জীবজগতের শান্তিভঙ্গ করে তাদের পরিসর সঙ্কুচিত করা হয় অবাধে। প্রকৃতি ও পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন চলল, তা সামলানো যাবে কী ভাবে? আলো, শব্দ ও ধোঁয়ার এই আগ্রাসনে, মণ্ডপ বা প্রতিমা গড়া থেকে বিসর্জনে— দূষণের দাপট সর্বত্র। মণ্ডপে, দেবীমূর্তিতে ব্যবহৃত প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক পরিবেশকে নষ্ট করে, স্থলজদের প্রভূত বিপত্তির কারণ তা। জলে পড়ার পর প্রতিমার রং, কাপড়ের টুকরো ব্যাহত করে জলজদের জীবনচক্র। নদীপাড়ে জমা জঞ্জাল ও প্লাস্টিকও বাস্তুতন্ত্রের অতি বড় শত্রু।
পুজো তো, খানিক অনিয়ম হবেই— এই মনোভাবেরই রাজত্ব। তাই গাছ বাঁচিয়ে আলোকসজ্জার আদালতের রায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আইন, শব্দ নিয়ে নির্দেশিকা সবই লঙ্ঘিত— বিসর্জনের সময় কিছু ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব রীতি অবলম্বন করা ছাড়া। সবুজ নিধন করে, অন্য প্রাণকে বিপদে ফেলে, বাস্তুতন্ত্রের বিঘ্ন ঘটিয়ে নিজেদেরই স্বার্থকে সঙ্কটে ফেলার এই তালজ্ঞানরহিত উল্লাসকেই কি উৎসব বলে? প্রশাসনকে বিষয়টিতে আরও সজাগ থাকতে হবে। পুজোর অনুমতিপত্রেই কবুল করিয়ে নেওয়া উচিত যে, মণ্ডপ থেকে প্রতিমা, আলোকসজ্জা, বাজি, বাজনা— সব কিছুর আয়োজনকে বিপদসীমার নীচে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, নয়তো অনুমতি প্রত্যাহার করা হবে। এবং, কোনও পুজোয় সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে সত্যিই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দিকে, যে পুজো প্রকৃতিকে রক্ষা করবে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহারে বাস্তুতন্ত্রের উপর চাপ লাঘব করবে, তাকে পুরস্কৃত করার নীতিও এ ক্ষেত্রে ফলদায়ী হতে পারে। মানুষ ও প্রাণিজগতের মধ্যে সমন্বয়-সাধনেই যে শারদোৎসবের প্রকৃত সারবত্তা, এই বোধের আবাহন না হলে প্রকৃতির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেই। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে ভুল সংশোধন বিধেয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)