E-Paper

পিছনের বেঞ্চি

পরিবর্তনকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে আজকের স্কুলশিক্ষার ছবিটি মাথায় রাখলে। সরকার-পোষিত ‘বাংলা স্কুল’গুলি আজ যে পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে তার কারণ নানাবিধ, তবে অন্যতম কারণ সেখানকার পাঠ-পরিবেশ বা ‘ক্লাসরুম কালচার’।

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৫ ০৬:২৪

বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ইউনিফর্ম পরতে হয় কেন? ‘নিয়ম’ বলে। যে নিয়ম আসলে বলতে চায়, পড়ুয়ারা সবাই এক পোশাক পরলে তাদের মধ্যে একতা ও সমত্বের বোধ আসবে। অথচ সেই বিদ্যালয়েই শ্রেণিকক্ষে পড়ুয়াদের বসার নিয়মটা আদৌ সমত্বসূচক নয়, যুগযুগান্ত ধরে চলে আসছে ক্লাসে শিক্ষকের টেবিলের ও-পারে পড়ুয়াদের বসার নিয়ম: সারিবদ্ধ ভাবে, সামনে থেকে পিছনে। তৈরি হয়েছে ‘সামনের বেঞ্চি’ আর ‘পিছনের বেঞ্চি’র ধারণা— ‘ভাল পড়ুয়া’রা সামনে বসবে আর তথাকথিত নিম্নমেধার পড়ুয়ারা পিছনে তথা ‘ব্যাকবেঞ্চ’-এ। মালদহের ইংলিশবাজারে শতাব্দীপ্রাচীন বার্লো গার্লস হাই স্কুল সম্প্রতি এই বৈষম্য ভেঙে খবরের শিরোনাম হয়েছে, সারিবদ্ধ বসার ধরন পাল্টে পড়ুয়াদের বসিয়েছে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে। এতে সব পড়ুয়াই থাকছে শিক্ষকের থেকে সমদূরত্বে, আসলে সমনৈকট্যে— সবাই ব্ল্যাকবোর্ডও দেখতে পাচ্ছে ভাল, বাড়ছে শ্রেণিকক্ষের পাঠে মানসিক অংশগ্রহণ।

এই পরিবর্তনকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে আজকের স্কুলশিক্ষার ছবিটি মাথায় রাখলে। সরকার-পোষিত ‘বাংলা স্কুল’গুলি আজ যে পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে তার কারণ নানাবিধ, তবে অন্যতম কারণ সেখানকার পাঠ-পরিবেশ বা ‘ক্লাসরুম কালচার’। এ রাজ্যে এই পরিব‌েশ বহুকাল ধরেই পক্ষপাতদুষ্ট, অসাম্যপীড়িত। আজ যাঁরা প্রবীণ, তাঁদেরও অনেকের স্কুল-স্মৃতিতে নিশ্চয়ই থাকবে ‘ব্যাকবেঞ্চার’দের প্রতি শিক্ষক ও সহপাঠীদেরও তাচ্ছিল্য। সব ছাত্র পড়াশোনায় ভাল হতে পারে না, তা বলে অমনোযোগী তথা ‘খারাপ’ ছাত্রদের বসার জায়গা পিছনের সারিতে নির্দিষ্ট হয়ে গেলে স্কুলশিক্ষার মূল শর্তটিই লঙ্ঘিত হয়: ক্লাসে সব পড়ুয়ার সমান যোগদানের অধিকার। সম অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরিতে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের বসার ব্যবস্থাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, মালদহের প্রাচীন স্কুলটি তা বুঝে নিজেদের এতকালের ‘নিয়ম’ পাল্টেছে— কম কথা নয়।

স্কুলে ছেলেমেয়েদের ‘গণতান্ত্রিক’ বসার ব্যবস্থা কয়েকটি বেসরকারি স্কুলে আছে। অনেক আবাসিক স্কুলে ক্লাস হয় সবুজের মাঝে, ছাত্ররা মাস্টারমশাইকে ঘিরে গোল হয়ে বসে, যেমন দেখা যেত শান্তিনিকেতনে। তবে এই সবই ‘ব্যতিক্রম’, সারিবদ্ধ ভাবে পড়ুয়াদের বসার অভ্যাসটিই এখনও ‘নিয়ম’। মালদহের স্কুলটির মতো বসার ব্যবস্থাটি সব স্কুলে চালু হলেই কি সব পড়ুয়া মনোযোগী, ‘ভাল ছাত্র’ হয়ে উঠবে? উত্তরটি জানা: না। অন্য বিষয়গুলিও জরুরি: শিক্ষকদের পড়ানো, শৃঙ্খলা, পাঠের বাইরের আনন্দপাঠ। পরিকাঠামো একটা বিরাট ব্যাপার— এ রাজ্যের অজস্র স্কুলে শ্রেণিকক্ষ ও তার শিক্ষা-আসবাবের এমনই দুরবস্থা যে বেঞ্চি-ব্যবস্থার বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারাও স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বিলাসিতা; অনেক স্কুলে সেটুকুও নেই, সব ছাত্র ক্লাসে এলে সবাই বসতেও পারবে না। এই অভাব-অব্যবস্থা পেরিয়ে কোনও স্কুল পড়ুয়াদের স্বার্থেই নিয়ম হয়ে ওঠা অনিয়মকে ভাঙছে, সে জন্যই তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। মালদহের স্কুলটির ক্ষেত্রে প্রেরণা হয়ে উঠেছিল একটি মালয়ালম সিনেমায় দেখা সামনের বেঞ্চি-পিছনের বেঞ্চি দ্বন্দ্ব, তা দেখেই স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়ম পাল্টানোর কথা ভাবেন। পাশে ছিল শিক্ষা প্রশাসনও। এই প্রেরণা ও সমর্থন জরুরি। স্কুলের ক্লাসরুম যেন কখনওই বৈষম্যের পাঠকক্ষ না হয়ে ওঠে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Students Schools Education

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy