কলকাতা কি দিনে দিনে এক ‘নেই’নগরী হয়ে উঠছে? এক-একটি বিপর্যয় আসে আর নাগরিক পরিষেবার যাবতীয় অভাব ও দৈন্য প্রকট হয়ে পড়ে, সাম্প্রতিক যে তালিকায় সবচেয়ে বড় দৈন্যের নাম মেট্রো পরিষেবা। যুগের চাহিদা মেনে কলকাতার মেট্রো এখন প্রসারিত, কিন্তু পৃথিবীর যে কোনও বড় শহরে মেট্রো-পথের সম্প্রসারণ যেখানে আনন্দের, কলকাতার নতুন মেট্রোপথ সেখানে নাগরিকদের মুখে চওড়া হাসি ফোটাতে পারছে না কেন? এক দিকে গ্রিন, ইয়েলো ও পার্পল লাইনের পুরোটা বা কিছুটা অংশ খুলে গেল, অন্য দিকে পুরনো ব্লু লাইনের পরিষেবা অবিশ্বাস্য ভাবে ধসে পড়ল— সেখানে দিনের যে কোনও সময়ে, যে কোনও পরিস্থিতিতে ট্রেনের সময়সূচি বিগড়ে যাচ্ছে, ঘোষণা ছাড়াই তাৎক্ষণিক ভাবে বাতিল হচ্ছে ট্রেন, ভিড় জমে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মে, এমনকি কর্তৃপক্ষ বেগতিক দেখলেই ইলেকট্রনিক বোর্ড অন্ধকার করে দিচ্ছেন— এ ভাবেই কি একটি মহানগরের মেট্রো পরিষেবা চলবে? এই চূড়ান্ত অপেশাদার, দায়বদ্ধতাহীন ভঙ্গিতে?
এ রকম চললে বিশেষ করে দুর্গাপুজোর এই দিনগুলোয় মেট্রো পরিষেবার কী দশা হবে, ভাবতেও আতঙ্ক হয়। মেট্রো স্টেশন সংস্কার হচ্ছে বলে কবি সুভাষ স্টেশনটি বছরখানেক বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত ইস্তক ব্লু লাইনে মেট্রো পরিষেবায় যে সার্বিক অব্যবস্থা শুরু হয়েছে, পুজো শুরু হওয়ার আগে তা পুরোপুরি সামলাতে পারা উচিত ছিল। শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে ক্রসওভার তৈরি, সময় ঠিক রাখতে ও ভিড়ের চাপ কমাতে মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশন থেকে দক্ষিণেশ্বরমুখী কিছু ট্রেন চালানো— এই সব করেও সেই অব্যবস্থার সিকিভাগও মিটেছে কি না বলা শক্ত। ব্লু লাইনটি কলকাতা মেট্রোর ‘জীবনরেখা’, সেখানে মেট্রো পরিষেবার সামান্যতম হেরফেরেও নাগরিক জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আবার মহানগরের বড় দুর্গাপুজোগুলিও এই লাইনের দু’পাশেই, পুজোর সময় মেট্রোয় চড়ে কী বিপুল সংখ্যক মানুষ এই মণ্ডপগুলিতে যান তার ইয়ত্তা নেই, প্রতি বছর পুজোর দিনগুলিতে মেট্রোর যাত্রিসংখ্যা রেকর্ড ছাড়ায়। আগামী কাল থেকে দশমী অবধি মেট্রো পরিষেবার সময়সূচি এর মধ্যেই ঘোষিত, সপ্তমী থেকে নবমী মেট্রো চলবে দুপুর ১টা থেকে রাতভর— কিন্তু ব্লু লাইনে মেট্রো পরিষেবার যে হাল তাতে আশঙ্কা হয়, একটি ট্রেনও যদি দেরি করে তা হলে কী পরিমাণ মানুষের চাপ স্টেশনগুলিতে বেড়ে যাবে; ঘটে যেতে পারে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাও। মেট্রো কর্তৃপক্ষ কি তা নিয়ে ভাবিত? পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে তাঁরা কি প্রস্তুত?
এক রাতের টানা বৃষ্টির জেরে এ সপ্তাহে শহর যখন অচল হল, তার জেরে ব্লু লাইনে মেট্রো পরিষেবাও ব্যাহত হয়েছে একেবারে বিকেল পর্যন্ত। মহানগরের সার্বিক দুর্ভোগ-চিত্রের মধ্যে আলাদা করে মেট্রোর দিকে আঙুল ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু এ কাণ্ড পুজোর মধ্যে হলে, বৃষ্টির জল স্টেশনে বা লাইনে ঢুকে পরিষেবা বিগড়ালে তা কোন বিভীষিকা হয়ে উঠবে, ভেবেও শিউরে উঠতে হয়। এখনও পর্যন্ত মানুষ সব অব্যবস্থার বিড়ম্বনা সহ্য করে মেট্রোয় চলাচল করছেন, কিন্তু উৎসবমুখর উত্তেজিত মানুষ কি তা সইবেন? খানিকটা ব্যবস্থাপনার জোড়াতালিতে, খানিকটা যাত্রীদের নির্লিপ্তিতে ভর করে চলেছে কলকাতার মেট্রো, উৎসবের চাপে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার আগে তার হুঁশ ফেরা দরকার, এই মুহূর্তেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)