অগস্ট মাসের এক-তৃতীয়াংশ পেরিয়ে গেল, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে ফের শুরু করা গেল না। কলকাতা হাই কোর্ট ১৮ জুন নির্দেশ দিয়েছিল, অগস্টের গোড়া থেকেই তা চালু করতে হবে। অথচ, ফের রাজ্যের শ্রম বাজেট খারিজ করল কেন্দ্র। যার অর্থ, কেন্দ্র-রাজ্যের জট আগের মতোই বহাল রইল। কবে মিলবে একশো দিনের কাজ, তার জবাব নেই কারও কাছে। দুশ্চিন্তা কেবল গ্রামবাসীর রোজগার নিয়েই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার অবাধে আইনের শাসনকে নস্যাৎ করছে। সংসদে পাশ করা আইনের সুরক্ষার মতো, আদালতের নির্দেশের বাস্তবায়নও ‘আইনের শাসন’-এর সংজ্ঞাতেই পড়ে। কলকাতা হাই কোর্ট ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, কাজ স্থগিত করা বেআইনি। কারণ, আর্থিক দুর্নীতির জন্য কাজ দেওয়া বন্ধ করা যায়, এমন কোনও শর্ত নেই ২০০৫ সালের এই আইনে। আদালত এ কথাও বলেছে যে, দুর্নীতির মোকাবিলা করার যথেষ্টক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রের হাতে। অতএব টাকা নয়ছয়ের জন্য প্রকল্প স্থগিত করা অনুচিত। মাস দেড়েকের সময় দিয়েছিল আদালত, পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্প পুনরায় চালু করতে। শ্রম বাজেট খারিজ করে কেন্দ্র সেই সময়সীমাকে লঙ্ঘন করল। কেন্দ্রের নীরবতা চলতে থাকলে হয়তো রাজ্যের তরফে, অথবা জনস্বার্থে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের তরফে, আদালত অবমাননার মামলা হবে। তা হবে আদালতে জমে থাকা মামলার বিশাল স্তূপে আরও একটি মামলা। তার ফল যা-ই হোক, আদালতের নির্দেশের মর্যাদা কি তাতে আহত হবে না? সরকারের অন্যায়ের প্রতিকার মিলবে আদালতে— এই বিশ্বাসও নষ্ট হবে।
আস্থা ক্ষয়ে আসছে রাজ্যের প্রতিও। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ পেতে রাজ্যের ধারাবাহিক ব্যর্থতা দু’টি কারণে— প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক। তত্ত্বের দৃষ্টিতে এ দু’টি আলাদা হলেও, বাস্তবে আলাদা করা সহজ নয়। স্কুলশিক্ষা নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে রয়েছে যোগ্য এবং অযোগ্য শিক্ষক বাছাই করার রাজনৈতিক অনিচ্ছায়। ঠিক তেমন ভাবেই একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ভুয়ো জব কার্ডধারীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাদের থেকে টাকা উদ্ধার করা, পুলিশে এফআইআর দায়ের করার কাজ এগোয়নি। কেন্দ্র যদি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অপচয় প্রতিরোধে এবং স্বচ্ছতা আনতে এই শর্তগুলি দিয়ে থাকে, তাতে দোষাবহ কিছু নেই। কিন্তু রাজ্য সে শর্ত পালন করতে অপারগ। সরকারি হাসপাতাল, সরকারি স্কুলের মতো, গ্রামীণ কাজের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, সরকারি আধিকারিকদের যেন হাত-পা বাঁধা— দলের প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্তদের রক্ষা করতে গিয়ে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া চালাতে পারছেন না। ভোটপিয়াসি দলীয় রাজনীতির ফাঁস প্রশাসনের গলায় যত চেপে বসেছে, ততই নাভিশ্বাস উঠছে রাজ্যবাসীর। দরিদ্রের ক্ষতির কোনও লেখাজোখা নেই। স্কুলে শিক্ষক, হাসপাতালে চিকিৎসক বা ঘরের কাছে কাজ না পাওয়া গেলে কত মানুষের জীবনে কত রকম বিপর্যয় আসে, তার হিসাব কষা অসম্ভব। এই অশেষ দুর্গতি থেকে শ্রমজীবী নারী-পুরুষকে উদ্ধার করতে পারবেন এ রাজ্যের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা, সে আশা করার সাহস আজ ক’জনের আছে?
রাজ্যের দুর্গতির আর একটি কারণ তথ্যে কারচুপি। তৃণমূল আমলে দীর্ঘ দিন মনরেগা-র প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল শীর্ষের কাছাকাছি। কর্মদিবস, শ্রমিকের সংখ্যা এবং শ্রমিকের মজুরির অঙ্ক দ্রুত বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এই বিপুল ব্যয়ের দুধ-জল নির্ধারণ করা আজ এক অসম্ভব কাজ। মজুরি বা প্রকল্প-নির্মিত গ্রামীণ সম্পদের ‘সোশ্যাল অডিট’-ও হুমকি-সংস্কৃতির সামনে অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রের নিষ্ক্রিয়তা যেমন রাজ্যের বঞ্চনা, তেমনই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থে দলীয় দুর্বৃত্তের উদরস্ফীতি রাজ্যের অবমাননা। অতএব কেন্দ্রের কাছে অবিলম্বে কাজ শুরুর দাবির পাশাপাশি, রাজ্যের কাছে স্বচ্ছতার দাবিও থেকেই যাচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)