গত কুড়ি দিনে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। কলকাতা এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে এ বারও ডেঙ্গি ফিরেছে স্বমহিমায়। পিছিয়ে নেই উত্তরবঙ্গের মালদহ এবং জলপাইগুড়িও। আক্রান্তের সংখ্যা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদ তালিকার শীর্ষে। আক্রান্ত বেড়েছে কলকাতাতেও। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ অগস্ট পর্যন্ত শুধুমাত্র কলকাতায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৫৫। চলতি বছরে তা হয়েছে ২৯০। আপাতদৃষ্টিতে, এই বৃদ্ধি খুব বেশি না হলেও আশঙ্কার কারণ আছে। ডেঙ্গির কোনও প্রতিষেধক এখনও বাজারে সহজলভ্য নয় এবং নির্দিষ্ট ওষুধও নেই। বরং দ্রুত প্লেটলেট কমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উদাহরণ অজস্র। এই ঋতুতেও একাধিক মৃত্যু দেখেছে কলকাতা-সহ রাজ্য। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গি সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে হাসপাতালগুলিতে শয্যা না মেলার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হতে হয়েছে নাগরিককে। রাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ প্রদত্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বছর দুইয়েক আগে এই রাজ্যেই ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল এক লক্ষ, যা বারো বছরে সর্বাধিক।
ডেঙ্গি ম্যালেরিয়া অচেনা রোগ নয়। প্রাদুর্ভাবের কারণ, প্রতিরোধের পন্থা— সবই বহুচর্চিত। তা সত্ত্বেও কলকাতার নির্দিষ্ট কিছু ওয়র্ডে যখন প্রতি বছর ডেঙ্গি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যায় বৃদ্ধি দেখা যায়, তখন সরকারি কথা আর কাজের মধ্যে ফারাকটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং আক্রান্ত যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, অস্পষ্টতা বাড়ে প্রকৃত সংখ্যা জানানোর সরকারি কাজটিতেও। বরং পরিস্থিতি জটিল হওয়ার উপক্রম হলেই পুর-প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে মূলত নাগরিক অ-সচেতনতাকে দায়ী করা শুরু হয়। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। ডেঙ্গির মশা গৃহ-অভ্যন্তরে জমানো জলের খোলামুখ পাত্রটিকেও তার বংশবিস্তারের জায়গা হিসাবে বেছে নেয়। তাই নিঃসন্দেহে, নাগরিক সহযোগিতা ছাড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কিন্তু, পুর-প্রশাসনও কি নিজ কর্তব্য পালনে যথেষ্ট তৎপর? শুধুমাত্র মশার তেল ছড়িয়ে ডেঙ্গিকে আটকানো যায় না। ডেঙ্গির মশা অতি ক্ষুদ্র পাত্রের জলটিকেও তার ডিম পাড়ার স্থান হিসাবে বেছে নেয়। সুতরাং, সারা বছর জঞ্জাল সাফাইয়ে নজর দেওয়া, সর্বোপরি নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগী হওয়া জরুরি। ব্যবহৃত প্লাস্টিক এক দিকে নিকাশির মুখ বন্ধ করে জল জমার পথটি প্রশস্ত করে, অন্য দিকে প্লাস্টিকের কাপ, বোতলের ছিপি মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ গড়ে দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে পুরসভা ডাহা ফেল করেছে।
একই রকম উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ম্যালেরিয়াও। সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার পর্যবেক্ষণে ১১টি ওয়র্ডের ৫০টি রাস্তা ম্যালেরিয়া-প্রবণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে। উষ্ণায়নের কারণে বাড়তে থাকা তাপমাত্রা, খামখেয়ালি বৃষ্টিপাত, দূষণ প্রভৃতি মশাবাহিত রোগ বিস্তারের আদর্শ অনুঘটক। প্রত্যেক বছরের প্রায় অর্ধ ভাগ জুড়ে মশাবাহিত রোগের দাপাদাপি অব্যাহত থাকলে জনস্বাস্থ্যের দিকটি তো বটেই, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রটিও প্রবল ভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা। উষ্ণায়নে রাশ টেনে ধরার আশাটি সুদূরপরাহত। তুলনায় সহজ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচিটি বছরভর মেনে চলা। সেই সদিচ্ছা পুরসভাগুলির আছে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)