রাজ্য জুড়ে একটি পালস পোলিয়ো কর্মসূচি হল, তাতে যোগ দিলেন না আশাকর্মীরা। গত রবিবার এমন অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী থাকলেন রাজ্যবাসী। নানা দাবি নিয়ে এর আগেও আশাকর্মীরা পথে নেমেছেন, কিন্তু এমন লাগাতার কর্মবিরতি দেখা যায়নি। একটি এলাকার প্রতিটি শিশু পোলিয়ো টিকা না পেলে সব শিশুরই ফের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়, তাই সার্বিক টিকাকরণ নিশ্চিত করা চাই। আশাকর্মীদের দাবি, লাগাতার কর্মবিরতি তাঁদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। প্রশ্ন ওঠে, শিশুর সুস্থতার থেকেও স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া চলে কি? প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র প্রসূতি ও নবজাতকরাও সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার নাগাল পাওয়ার জন্য নিয়ত আশাকর্মীদের উপর নির্ভরশীল। লাগাতার কর্মবিরতির জন্য তাদের কত জনের কত বিপদ হচ্ছে, কে বলতে পারে? শিক্ষক ধর্মঘট বা চিকিৎসক ধর্মঘটের চেয়ে আশাকর্মীদের কর্মবিরতির জন্য উদ্ভূত নৈতিক ও ব্যবহারিক সঙ্কটের তীব্রতা কিছু কম নয়। নানা জেলায় অবশ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকরা দাবি করেছেন যে, আশাকর্মীরা সক্রিয় না হলেও পালস পোলিয়ো কর্মসূচিতে সমস্যা হয়নি। সে দাবি কতটা সত্য, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। যে কোনও জনপদে প্রায় প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছে আশাকর্মীদের। কতগুলি শিশু পালস পোলিয়ো কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেল, তা আশাকর্মীদেরই নখদর্পণে থাকার কথা। ইতিপূর্বে তাঁরা দায়িত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করেছেন। এ বার কেন স্বাস্থ্য দফতর রাজ্যের অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মীকে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির অংশীদার করতে ব্যর্থ হল, সে প্রশ্নটা স্বাস্থ্য ভবনকেও করা দরকার।
আশ্চর্য, কোভিড অতিমারির সময়ে এই আশাকর্মীরাই স্বার্থচিন্তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁদের খবর নিয়েছিলেন। সারা রাজ্য, তথা দেশের কাছে তাঁরা কোভিডের বিরুদ্ধে ‘প্রথম সারির যোদ্ধা’ বলে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন, সরকার তাঁদের সেই সম্মানও দিয়েছিল। বহু আশাকর্মী সে সময়ে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে, এমনকি দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করে সহায়তা করতে গিয়ে, ঘরে-বাইরে তীব্র প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন। সে সব কাহিনি কর্তব্যপরায়ণতার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। রাজ্য সরকারের কাছে আশাকর্মীরা নানা উপঢৌকন পেয়েছেন। যা পাননি, তা হল মূল চাহিদাগুলি— সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি, নির্দিষ্ট হারে, স্বচ্ছ ভাবে নির্ধারিত সম্মানজনক মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা।
এমন দাবি সামনে রেখে আন্দোলন করছেন আশাকর্মী, তথা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মহিলা-কর্মীরা। প্রশ্ন হল, এ রাজ্যেই কেন পরিস্থিতি এমন হল যে, আশাকর্মীদের দীর্ঘ কর্মবিরতিতে নামতে হল? এর সম্ভাব্য কারণ, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের জরুরি ক্ষমতাটি হারিয়েছে এ রাজ্যের প্রশাসন তথা শাসক দল। আশাকর্মীদের দাবিগুলি অন্যায্য, এমন নয়। মেয়েদের কাজকে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ বলে দেখানোর সরকারি প্রবণতা নারীশ্রমের অবমূল্যায়ন করে। বিষয়টি আলোচনার। আক্ষেপ, এত বছর বরখাস্ত করার ভয় দেখিয়ে স্বাস্থ্য কর্তারা এই মহিলা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। ক্ষোভ ছড়িয়েছে বলেই কর্মবিরতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই অচলাবস্থার নিরসনে তৎপর হতে হবে দু’পক্ষকেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)