—প্রতীকী ছবি।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করার অভিযানে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন শিক্ষানীতি নামক বুলডোজ়ারটি যখন প্রবল গতিতে এগিয়ে চলেছে, সেই সময়ে কাউন্সিল ফর দি ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট এগজ়ামিনেশনস-এর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে বিশেষ ভাবে অভিবাদন জানাতে হয়। সিআইএসসিই-র পরিচালকরা নির্দেশ দিয়েছেন, দশম শ্রেণির শেষে আইসিএসই এবং দ্বাদশ শ্রেণি তথা স্কুলজীবনের শেষে আইএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নের ধারায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এমন প্রশ্নের অনুপাত বাড়ানো হবে, যার ধরাবাঁধা এবং পূর্বনির্ধারিত উত্তর নেই, উত্তর সন্ধানের জন্য শিক্ষার্থীদের যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রশ্নগুলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। ‘ঠিক উত্তর’ লিখে দেওয়া বা সেটিতে টিক দেওয়ার যান্ত্রিক মূল্যায়ন নয়, ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিবোধ যাচাই করাই হবে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লক্ষণীয়, এক ধাক্কায় গোটা প্রশ্নপত্রের চরিত্র পাল্টে দেওয়া হচ্ছে না, আগামী কয়েক বছরে ক্রমে ক্রমে সেই সংশোধন আনা হবে, এবং এই পরিমার্জন ঘটবে নীচের ক্লাসগুলি থেকেই, যাতে ছাত্রছাত্রীরা আকস্মিক কোনও সমস্যায় না পড়ে, শিক্ষকদেরও অসুবিধা না হয়। কী ভাবে নতুন ধাঁচের প্রশ্নগুলি তৈরি করতে হবে এবং কী ভাবে তাদের উত্তর খুঁজতে ও লিখতে হবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ব্যবস্থাও করেছে কাউন্সিল। শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালনা কী ভাবে করা উচিত, এই উদ্যোগটি তার এক প্রকৃষ্ট নজির। পশ্চিমবঙ্গে স্কুলশিক্ষার পরিচালনা যাঁদের কাজ, এই প্রসঙ্গে তাঁদের কথা স্মরণ করলে রাজ্যবাসীর হৃদয়পুর থেকে একটি প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাস উঠে আসবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কেবল প্রশ্নপত্র সংশোধনের পদ্ধতি নয়, তার উদ্দেশ্যটিও প্রশংসনীয়। বস্তুত, ছাত্রছাত্রীদের যথার্থ শিক্ষার স্বার্থেই এই সংশোধন জরুরি। সুশিক্ষার প্রথম শর্ত একেবারে শৈশব থেকে ছেলেমেয়েদের দু’টি ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়া এবং সাহায্য করা: অনুসন্ধিৎসা এবং চিন্তাশক্তি। মনে রাখতে হবে, জ্ঞানোন্মেষের প্রথম পর্বে অধিকাংশ শিশুর মনে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রবল কৌতূহল থাকে এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতো চিন্তা করতেই অভ্যস্ত— শিশুদের জগতে নিশ্চিন্দিপুরের অপূর্বকুমার রায়ের মতো ‘হাঁ-করা ছেলে’ বা মেয়েরা স্বভাবতই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের শিক্ষার ভিতটি জোরদার। শিক্ষক তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত কাজ হল শিক্ষার্থীর অন্তর-নিহিত সামর্থ্যের স্ফূর্তির জন্য তাকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করে যাওয়া, পাঠক্রম এবং পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবধি সব কিছুই সেই সহযোগিতার প্রকরণ। শিক্ষা ‘দান’ নয়, শিক্ষার বিকাশই বিদ্যাচর্চার প্রকৃত উদ্দেশ্য।
আক্ষেপের কথা, এবং উদ্বেগেরও কথা, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে এই মূল শর্তটিই উত্তরোত্তর লঙ্ঘিত হয়েছে। বাঁধা গতের পঠনপাঠন এবং মুখস্থ-বিদ্যার আধিপত্য নিরন্তর শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসাকে দমন করে এবং তাদের নিজস্ব চিন্তার গতিকে রোধ করে, প্রকৃত শিক্ষার বহতা স্রোত এই তোতাকাহিনির মরুপথে তার ধারাটিকে হারিয়ে ফেলে। সিআইএসসিই-র উদ্যোগ এই অবক্ষয়ের ইতিহাস বদলানোর একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সম্ভাবনা কত দূর সার্থক হবে, তা অবশ্যই নির্ভর করছে শিক্ষকদের— এবং অভিভাবকদের— উপর। তাঁরা কি ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসাকে উৎসাহ দেবেন? তাদের নিজের মতো করে ভাববার সুযোগ করে দেবেন? কাজটি সহজ নয়। তরুণ মনের জিজ্ঞাসা অনেক সময়েই প্রাপ্তবয়স্কের দৃষ্টিতে ‘অবান্তর’ মনে হবে, তার চিন্তাভাবনা ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু সেই ধারণা বা ইচ্ছাকে অতিক্রম করেই ছাত্রছাত্রীদের চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া চাই। তবেই শিক্ষার মুক্তি সম্ভব। প্রশ্নের ধারা বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষণের ধারা বদলাবে কি না, সেটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন। পরীক্ষা কেবল শিক্ষার্থীর নয়, শিক্ষাব্যবস্থারও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy