Advertisement
২২ মে ২০২৪
Valentines Day

করোনার প্রেমশিক্ষা

কোভিডজনিত লকডাউন, কোয়রান্টিন, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ববিধি ভালবাসাতেও প্রভাব ফেলিয়াছিল।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৫১
Share: Save:

এক বৎসর পূর্বেই চিত্রটি ভিন্ন ছিল। ভালবাসার কোনও একটি দিবস হয় না, ভালবাসা লইয়া উদ্‌যাপনের এই অতিরেক আসলে চূড়ান্ত অপসংস্কৃতি— প্রতি বারের এই সংবিগ্ন ও দ্বিধাবিভক্ত মতবাদীদের কাজিয়ার অন্তরালেই ভালবাসা দিবসে আবেগ উদ্‌যাপন উপহারে ভাসিয়াছিলেন প্রণয়ীসকল। অতিমারির একটি বৎসরে জগৎ ও জীবন পাল্টাইয়া গিয়াছে। মনস্তত্ত্ববিদরা বলিতেছেন, কোভিডলাঞ্ছিত সময়ে জীবনের অর্থ নূতন করিয়া বুঝাইয়াছে প্রেম-ভালবাসার ন্যায় অনুভূতি ও মনোবৃত্তিগুলি। নব্বই দশকের বিখ্যাত এক ইংরেজি গানে ছিল ‘ভালবাসাই আমাদের বাঁচাইয়া রাখিবে’, বিশ্বব্যাপী এক চরম স্বাস্থ্য-দুর্যোগের আবহে তাহাই যেন প্রমাণিত হইল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিজ্ঞান কোভিডের প্রতিষেধক আনিয়াছে, সেই কীর্তিকে অভিবাদনের পরেও এই উপলব্ধির সারবত্তা অক্ষুণ্ণ রহিয়া যায়: দুর্বহ পীড়াপ্রকোপে সন্তপ্ত মনে ভালবাসা প্রলেপ দিয়াছে, প্রতিষেধকের কাজ করিয়াছে।

কোভিডজনিত লকডাউন, কোয়রান্টিন, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ববিধি ভালবাসাতেও প্রভাব ফেলিয়াছিল। শুধু এই শহর, রাজ্য বা দেশেই নহে, সারা বিশ্বেই প্রিয়জনের নিকট হইতে দূরে, দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ হইয়া কাটাইতে হইয়াছে অগণিত মানুষকে। আধুনিক পৃথিবীতে এখন জীবনধারণের প্রয়োজনে মা ও সন্তান, ভাই ও বোন, স্বামী ও স্ত্রী, প্রণয়ীযুগলের মধ্যে অনেক সময়েই বিস্তর ভৌগোলিক দূরত্ব। যে দূরত্ব চাহিলেই পার হওয়া যাইত, কোভিড তাহাকেই অনতিক্রম্য করিয়া তুলিয়াছিল। আবার উল্টা কাণ্ডও হইয়াছে, লকডাউনে সর্বক্ষণ গৃহমধ্যে ও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে থাকিতে বাধ্য হইয়াছে বহু মানুষ। এক দিকে দূরত্বসম্ভূত ভালবাসার আকুতি, অন্য দিকে চূড়ান্ত নৈকট্য হেতু হাঁসফাঁস, এই দুইটি অবস্থাই মানুষকে শিখাইয়াছে: ভালবাসা অতি বিষম বস্তু। মনের মানুষ দূরে থাকিলে দম আটকাইয়া আসে, আবার সর্বক্ষণ কাছে থাকিলেও মুশকিল, পরস্পরের তিলসদৃশ খুঁতগুলি তালপরিমাণ দেখিতে লাগে। মানবসম্পর্ক বিশারদরা দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন, অত্যধিক দূরত্ব বা নৈকট্যের সহিত ভাইরাসভীতি হাত মিলাইয়া মনকে কাবু করিয়া ফেলিবার সম্ভাবনা প্রবল; ভয় যদি বা ক্রমশ জয় করা যায়, সম্পর্কে ঠোকাঠুকি লাগিতেই পারে। আবার এক হাজার যুগলকে লইয়া করা এক আমেরিকান সমীক্ষা দেখাইয়াছে, ৬৩ শতাংশের মতে করোনাকালীন নৈকট্য তাঁহাদের ভালবাসাকে মজবুত করিয়াছে। অতিমারি-আবহে তাঁহারা সম্পর্কের মৌলগুলিতে নজর দিয়াছেন— প্রথম সুযোগেই একত্রবাসে ফিরিয়াছেন, বাড়ি সারাইয়াছেন, পোষ্য লইয়াছেন, ব্যায়াম-টিভি-বই-বাগান’সহ নূতন শখে মাতিয়াছেন, এমনকি ঘর ও কর্মক্ষেত্রের কাজ সারিয়া একান্ত সময়, নিজস্ব পরিসরও গড়িয়া লইয়াছেন। নূতন সম্পর্কও থামিয়া থাকে নাই। লন্ডনে এক ডাক্তার-নার্স যুগল হাসপাতালেই বিবাহ করিয়াছেন, নিউ ইয়র্কে গৃহবন্দি এক আলোকচিত্রীর ড্রোনে প্রেরিত প্রেমপ্রস্তাব সানন্দে গৃহীত হইয়াছে, কেরলে আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হওয়া বিবাহ-অনুষ্ঠানে ডাকযোগে নূতন বস্ত্র ও মঙ্গলসূত্র পাঠাইয়াছেন নবদম্পতির পিতামাতারা। চারি পাশের দুঃখ, মৃত্যু ও বিরহদহনের মধ্য দিয়াও ভালবাসা ঠিক পথ করিয়া লইয়াছে।

ক্রমশ সহজ হইয়া আসা পৃথিবীতে আজিকার দিনটি উদ্‌যাপনের অন্তরে থাকুক সম্প্রতি-লব্ধ উপলব্ধি: ভালবাসাই জীবনের চালিকাশক্তি। বিজ্ঞান বলে স্পর্শের কথা, অক্সিটোসিন-ক্ষরণে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হইবার কথা। কোভিড-১৯ আসিয়া ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেই স্পর্শেও লক্ষ্মণরেখা টানিয়াছিল, বিজ্ঞানীরা এমনকি শরীর-সম্পর্ক ব্যতিরেকে যৌনতা বা ঘনিষ্ঠতার উপকরণ-প্রকরণের কথা বলিতেছিলেন। এক দিকে প্রচণ্ড উদ্বেগ, অন্য দিকে গভীর আকুতি, দুইয়ের টানাপড়েনে পর্যুদস্ত হইতেছিল ভালবাসা। কোভিড এখনও যায় নাই, আজিকার দিনটিও বাঁধভাঙা প্রগল্‌ভতায় ভাসাইয়া দিবার কারণ নাই। বরং ভালবাসার শিক্ষাটি লওয়া ভাল। প্রিয়জনকে হারাইয়া একাকী কাটাইতেছেন যে মানুষ, ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচাইয়া এখনও একত্র হইতে পারিতেছেন না যে যুগল, বন্ধু বা প্রণয়ী বিচ্ছেদ ঘটিল যাঁহাদের, দাম্পত্য বা প্রেমসম্পর্ক টিকাইতে প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছেন যাঁহারা— তাঁহাদের পাশে দাঁড়াইবার শিক্ষা। বহিরঙ্গে সহাস্য কত মানুষ এখনও চার দেওয়ালের ভিতরে ক্লান্তি, হতাশা, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি যাপন করিতেছেন, কিংবা প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটাইতে নিজ সুখ স্বস্তি যত্ন ভুলিয়াছেন, তাঁহাদের ভালবাসায় স্পর্শ করিবার শিক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Valentines Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE