সাক্ষী মালিক। —ফাইল চিত্র।
তোমার নীতিবোধ নেই, গণতন্ত্র’? বছর শেষে নিজের অবসর ঘোষণার সময় সাক্ষী মালিক এই প্রশ্নটি করতেই পারতেন। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনে ৪০-৭ ভোটে, একেবারে গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে, জয়ী হলেন যিনি, তিনি ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের অতি ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক কিছু একটা কারণ দেখিয়ে আপাতত সেই প্যানেল বাতিল করেছে বটে, কিন্তু তাতে ছবিটি কিছুমাত্র পাল্টায় না। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের ভূতপূর্ব সর্বময় কর্তা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনে বছরের গোড়ায় ধর্নায় বসেছিলেন দেশের প্রথম সারির কুস্তিগিররা। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে তদন্ত হল, তার রিপোর্ট প্রকাশিত হল না। কোনও ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হল না। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের সবলে গ্রেফতার করল পুলিশ। মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, ফেডারেশনের নির্বাচনে ব্রিজভূষণ সিংহ বা তাঁর পরিবারের কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যিনি জয়ী হলেন, তাঁর সম্বন্ধে প্রত্যাশাই হল, তিনি সিংহাসনে ব্রিজভূষণের পাদুকাদ্বয়কে প্রতিষ্ঠা করে জোড়হস্তে পাশে বসে থাকবেন। অনুমান করা চলে, ফেডারেশনে যাঁরা তাঁকে ভোট দিলেন, তাঁদের ভোট আসলে ব্রিজভূষণ সিংহের প্রতিই। অর্থাৎ, কুস্তিগিররা গোটা বছর যে প্রতিবাদ করলেন, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে যতখানি লজ্জিত হতে হল, তার কোনও ছাপ এই নির্বাচনে পড়েনি। কেন, তার বহুবিধ কারণ থাকা সম্ভব। কিন্তু, সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ হল, ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করার জন্য নৈতিকতার গণ্ডি অতিক্রম করা এখন অনায়াসসাধ্য। তার জন্য আর বোধ হয় ভাবতেও হয় না।
গত এক বছর ধরে যে কুনাট্য চলল, তাতে স্পষ্ট যে, শুধু কোনও একটি ক্রীড়া ফেডারেশনের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরেও গণতন্ত্র আর নৈতিকতার আব্রুরক্ষায় আগ্রহী বা সক্ষম নয়। ব্রিজভূষণ সিংহ শাসক দলের সাংসদ, উত্তরপ্রদেশের এক বিপুল অঞ্চলে তাঁর প্রবল রাজনৈতিক প্রতাপ। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সাক্ষী মালিক-বজরং পুনিয়ারা তুলেছিলেন, তা সামান্য নয়— কিন্তু, ব্রিজভূষণের গায়ে তার আঁচটুকুও লাগেনি। ‘বেটি বচাও’ রব তোলা দেশে কৃতী ‘বেটি’দের অভিযোগ উপেক্ষিতই থাকল। বরং, যে ভঙ্গিতে দিল্লি পুলিশ গোটা ঘটনাটি সামলেছে তাতে আশঙ্কা হয় যে, অভিযোগের তদন্ত করার বদলে অভিযুক্তকে আড়াল করা এবং অভিযোগকারীদের দমন করার দিকেই পুলিশের আগ্রহ বেশি ছিল। দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, গোটা ২০২৩ সাল জুড়ে ঘটনাক্রম যে ভাবে প্রবাহিত হল, তাতে স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে যাঁরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের চেয়ে রাষ্ট্রের কাছে ব্রিজভূষণ সিংহের মতো নেতার গুরুত্ব বেশি। দেশের অন্য ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের বেশির ভাগও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সহ-খেলোয়াড়ের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে রাষ্ট্রের সুনজরে থাকা তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষী মালিকরা যে অবহেলা ও অপমানের শিকার হলেন, তা অবশ্য ভারতের যে কোনও মহিলার কপালেই জোটে, বিশেষত তাঁরা যখন কোনও ক্ষমতাবান পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনী তোলেন, তখন। মহিলাদের প্রতি দেশের শাসক শিবিরের মনোভাব কেমন, বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে তা অতি প্রকট। মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের ঘটনায় বর্তমান শাসকদের অবস্থান কী, তার উদাহরণও না খুঁজলেই মেলে। পুরুষ-আধিপত্য— বিশেষত উচ্চবর্ণের পুরুষ আধিপত্য— মেনে নিয়ে বাঁচাই যে এ দেশের মহিলাদের থেকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ, গত কয়েক বছর ধরেই সেই কথাটি ক্রমবর্ধমান দাপটের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। ২০২৩-এ কুস্তিগিরদের হেনস্থায় শাসকদের অবস্থান বুঝিয়ে দিল, প্রক্রিয়াটি তার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy