E-Paper

অন্য বয়ান

অতীত ও সমসময়কে নিজেদের শর্তে ও স্বার্থে ব্যাখ্যা ও প্রচার— আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের এই প্রবণতা ও আচরণ নতুন নয়।

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৫
Vladimir Putin.

ভ্লাদিমির পুতিন। —ফাইল চিত্র।

যত দিন না সিংহেরা লিখতে শিখবে, প্রতিটি গল্প গাইবে শিকারিরই জয়গান, লিখেছিলেন নাইজিরিয়ার লেখক চিনুয়া আচিবি। সেই সত্যই আরও এক বার প্রমাণিত হল সম্প্রতি, রাশিয়ার স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইয়ে। সদ্যপ্রকাশিত, রুশ সরকার অনুমোদিত বইটি আগামী সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে মাধ্যমিক স্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে পড়ানো হবে, শিক্ষার্থীরা পড়বে ১৯৪৫ থেকে শুরু করে একেবারে সম্প্রতিকাল পর্যন্ত রুশ ইতিহাস। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ণনা সেখানে পর্যবসিত ‘শিকারির জয়গান’-এ। সাফাইও গাওয়া হয়েছে বিস্তর: প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ সামরিক পদক্ষেপ’ না করলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হত, আগাগোড়া ‘রুশ-বিদ্বেষী’ পশ্চিমি শক্তিগুলি রাশিয়ার স্থিতি বানচাল করতে বদ্ধপরিকর, রাশিয়াকে ধ্বংস করে তার বিপুল খনিজ সম্পদের দখল নেওয়াই তাদের মতলব ইত্যাদি। ইউক্রেনকে লেখা হয়েছে পশ্চিমি শক্তির হাতের পুতুল, চরমপন্থীদের আখড়া, সিংহভাগ ইউক্রেনীয় নাকি রুশ পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাস থেকে উদ্ধার করতেই রাশিয়ার এই যুদ্ধ।

অতীত ও সমসময়কে নিজেদের শর্তে ও স্বার্থে ব্যাখ্যা ও প্রচার— আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের এই প্রবণতা ও আচরণ নতুন নয়। সেই সূত্রেই এক-একটি শব্দ পাল্টে যায় অন্য শব্দে: যুদ্ধ নয়, বিশেষ সামরিক কর্মসূচি; আক্রমণ নয়, জনতার বিদ্রোহ। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এই পরিবর্তিত ইতিহাস পড়ানোর সিদ্ধান্তটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক নিশ্চয়, তবে তার অন্য মাত্রাটি হল শিক্ষার্থীদের মাথা ও মনের দখল নেওয়া। শিশু-কিশোরদের যদি ছেলেবেলা থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে বাকি বিশ্ব যা-ই দেখুক বলুক, ইউক্রেনে রাশিয়ার ভূমিকাটি আসলে উদ্ধারকারীর, তা হলে দেশের মাটিতে এক বিপুল অংশের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন নিশ্চিত হয়। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি শব্দ সত্য বলে বিশ্বাস করে, তাই ইতিহাস বইয়ের বয়ান মুচড়ে পাল্টে নিজেদের মতো করে ছাপাতে পারলেই রাষ্ট্রের কার্যোদ্ধার। এই ‘প্রকল্প’-এ সঙ্গী হয় ভুল তথ্য, বিকৃত ব্যাখ্যা: যেমন এই ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়েছে ২০১৪ পর্যন্ত ইউক্রেনের ৮০% মানুষ রুশ ভাষাকেই মাতৃভাষা বলে গণ্য করতেন, অথচ ইউক্রেনের প্রধান অর্থনীতি-সমাজতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা ২০০৬-এই দেখিয়ে দিয়েছে সংখ্যাটা মাত্র ৩০%। ন’বছর আগে রাশিয়ার ইউক্রেন-হানাকে বলা হয়েছে ‘স্বেচ্ছাসেবী’দের অভিযান— ইউক্রেনীয়রা নাকি আজীবন রুশ থাকতে চেয়েছিলেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে!

রাজনীতির বাজার তো হাতেই আছে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির দখল নেওয়া আধিপত্যবাদের শেষ কথা। শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করতে পারলে, পাঠ্যবইয়ের কৌশলে শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের মতে টেনে আনতে পারলে সেই ফন্দি হাসিল হয়। রাশিয়ার ইতিহাস বই তারই প্রমাণ। অন্য দেশে অন্য মাটিতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসে যা ঘটেছে তার প্রকৃত ব্যাখ্যা পাল্টে লেখা হচ্ছে রাষ্ট্রের সুবিধাবাদী বয়ান। ব্যতিক্রমও আছে। জার্মানিতে শিশুরা যে ইতিহাস পড়ে, সেখানে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দেশটার কুকীর্তিকে অন্য ভাষায় লেখা হয় না, হলোকস্ট-এর ইতিহাস পড়া সেখানে বাধ্যতামূলক। তবে ব্যতিক্রম দেখে কে আর কবে রীতি কিংবা নীতি পরিবর্তন করছে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Russia Russia Ukraine War Vladimir Putin

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy