Advertisement
১১ মে ২০২৪
Bulldozer

‘বিজয়রথ’

এই বুলডোজ়ারের চালিকাশক্তিটি এক বিশেষ গোত্রের রাজনীতি, যেখানে নেতা জনগণের কাছে কোনও বাধাই সহ্য করবেন না।

A Photograph of Yogi Adityanath, Chief Minister of Uttar Pradesh

আদিত্যনাথের রাজনীতি এবং আরও বেশি করে তাঁর প্রশাসনিকতার সঙ্গে বুলডোজ়ারের সম্পর্ক ক্রমে অবিচ্ছেদ্য হচ্ছে। ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:১৫
Share: Save:

আইনি অধিকার নয়। সাংবিধানিক সমতাও নয়। বরং বুলডোজ়ারের বেপরোয়া দাপট এখন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি থেকে উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীর বহু জায়গায় শাসকের পছন্দের অস্ত্র। কানপুরের কাছে মাদাউলি গ্রামে সম্প্রতি মহকুমাশাসক, রাজস্ব-অফিসার প্রমুখ সরকারি কর্তাব্যক্তির উপস্থিতিতে যে ভাবে এক মা ও মেয়ে প্রাণ হারালেন, তাঁদের মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁইটুকুও বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, কোনও সভ্য দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা আগে বিশ্বাস হত না— এখন খুব সহজেই হয়। প্রথমে গ্রামবাসীদের অভিযোগ না নিলেও পুলিশ পরে সরকারি কর্তাব্যক্তি-সহ ৩৯ জনকে গ্রেফতার করেছে, যদিও তাতে এই ঘটনার অন্যায় কমে না।

এই বুলডোজ়ারের চালিকাশক্তিটি— রাজনীতি। এক বিশেষ গোত্রের রাজনীতি, যেখানে নেতা জনগণের কাছে নিজের এই ভাবমূর্তি তৈরি করতে চান যে, তাঁর পথে কোনও বাধাই তিনি সহ্য করবেন না। প্রবণতাটির সূচনা যে যোগী আদিত্যনাথদের হাতে নয়, সে কথা বলা প্রয়োজন। ‘পুলিশ গুলি চালাক, মানবাধিকার-টাধিকার আমি বুঝে নেব’, এ কথা বহু শাসক বলেছেন, অারও বেশি সংখ্যক শাসক ভেবেছেন। বিরুদ্ধ মতের উপরে বুলডোজ়ার চালিয়ে দেওয়ার বাসনা রাজনৈতিক ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে ভারতে। আদিত্যনাথের কৃতিত্ব, কথাটিকে রূপকার্থে ব্যবহার না করে তিনি তার আক্ষরিক প্রয়োগ করেছেন। অনুমান করা চলে, সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশও বুলডোজ়ারের নতুন শক্তিতে মোহিত— অপরাধীর চটজলদি শাস্তি, এক ধরনের শ্রেণিসংঘর্ষ, সবই যেন মিশে থাকে এই যন্ত্রে। প্রতীক অনেক সময় বহুকৌণিক অর্থের ইঙ্গিত দেয়। এই বহুস্তরীয় অর্থ না বুঝলে কেন বিরোধীদের ‘বুলডোজ়ার বাবা’ আখ্যা নিয়েও যোগী আদিত্যনাথ দ্বিতীয় বার ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেন, কেনই বা উন্নয়নের প্রতাপ-অন্ধতায় বুলডোজ়ার আজ বিভিন্ন রাজ্যে ব্যবহৃত হয়, বোঝা যাবে না। প্রয়াগরাজ, কানপুর থেকে শুরু করে সর্বত্র ঝামেলা ঘটলেই বুলডোজ়ারে ভেঙে দেওয়া হয় হাঙ্গামাবাজদের আস্তানা। এই সব আস্তানা বেশির ভাগই বস্তি, ঝুপড়ি এবং একতলা বাড়ি। এবং বেশির ভাগ জায়গাতেই একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের বাস। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কানপুরের ঘটনায় এতগুলি গ্রেফতারি কি মা ও কন্যার ব্রাহ্মণ পরিচয়ের কারণেই?

আদিত্যনাথের রাজনীতি, এবং আরও বেশি করে তাঁর প্রশাসনিকতার সঙ্গে বুলডোজ়ারের সম্পর্ক ক্রমে অবিচ্ছেদ্য হচ্ছে— খোলা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু প্রবণতাটি শুধু উত্তরপ্রদেশের ভৌগোলিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি, তা কিছু বিশেষ রাজ্যের চরিত্রলক্ষণও নয়। দেশে সর্বোচ্চ স্তর থেকে যে অগণতান্ত্রিকতার প্রচ্ছন্ন, এবং অবস্থাবিশেষে প্রকট, বার্তা প্রবাহিত হচ্ছে, এই প্রবণতা তারই প্রতিফলন। বিরুদ্ধ, প্রতিস্পর্ধী মতকে বুলডোজ়ারের নীচে পিষে দেওয়ার দৃশ্যটি তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। ‘উন্নয়ন’-এর সেই চৈনিক মডেলটিই কি ভারত-অধীশ্বরদের আরাধ্য হয়ে উঠছে? রাষ্ট্র যাকে ‘উন্নয়ন’-এর শত্রু জ্ঞান করবে, তা রাজনৈতিক মতবাদের কারণেই হোক বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে, তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমেই তা হলে বিজয়রথ অগ্রসর হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE