E-Paper

নারীর নিয়ন্ত্রণ

তৃণমূলের দলীয় দফতরে মেয়েদের রাতে ডাকা হয়েছে, দিনের পর দিন তাঁদের অপমানিত, নিগৃহীত করা হয়েছে, ভয় দেখিয়ে নানা অনুশাসন মানতে বাধ্য করা হয়েছে, সন্দেশখালির নানা গ্রামের মেয়েদের মুখে এই সব অভিযোগ তৃণমূল দলটির এক অনপনেয় কলঙ্ক।

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৫
An image of Sandeshkhali

উত্তপ্ত সন্দেশখালি। —ফাইল চিত্র।

সন্দেশখালিতে নারী-নির্যাতনের যে ছবি সামনে আসছে, তা মেরুদণ্ড দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দেয়। মেয়েরা কেউ প্রকাশ্যে, কেউ মুখ ঢেকে, মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে তাঁদের উপর নিগ্রহের বিবরণ দিচ্ছেন, প্রতিকার দাবি করছেন। আদালতে অন্তত দু’জন মহিলার গোপন জবানবন্দির ভিত্তিতে ধর্ষণ ও খুনের চেষ্টার ধারায় মামলা করা হয়েছে শেখ শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরার বিরুদ্ধে। শাহজাহান ছিলেন জেলা কর্মাধ্যক্ষ, শিবু তৃণমূলের সন্দেশখালি ২ ব্লক সভাপতি। তৃণমূলের দলীয় দফতরে মেয়েদের রাতে ডাকা হয়েছে, দিনের পর দিন তাঁদের অপমানিত, নিগৃহীত করা হয়েছে, ভয় দেখিয়ে নানা অনুশাসন মানতে বাধ্য করা হয়েছে, সন্দেশখালির নানা গ্রামের মেয়েদের মুখে এই সব অভিযোগ তৃণমূল দলটির এক অনপনেয় কলঙ্ক। এত বিস্তীর্ণ এলাকায় মেয়েদের উপর এত দীর্ঘ দিন ধরে, এত অবাধে নিগ্রহ হতে পেরেছে দলীয় ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার শক্তিতেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের বিন্দুমাত্র পরিচয় রয়েছে, তাঁরাই বুঝবেন যে সন্দেশখালির নারী-নির্যাতন ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নয়। স্থানীয় মানুষের উপরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তাঁদের সম্পদ হস্তগত করার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থার অঙ্গ। অতীতে এ রাজ্যে কামদুনি, হাঁসখালি, সন্দেশখালি— মেয়েদের উপর ধর্ষণ-নির্যাতনের যত ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে, প্রতিটিতেই সেই অপরাধের পিছনে রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট দুর্বৃত্ত এবং নিষ্ক্রিয়, কর্তব্যচ্যুত পুলিশ-প্রশাসনের চেহারা সামনে এসেছে। শিবু হাজরাকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করে তৃণমূল সন্দেশখালির নারী-নির্যাতন থেকে দলের দূরত্ব তৈরি করতে চাইলে তা হবে হাস্যকর।

মমতা রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, এ তথ্যটি সন্দেশখালির প্রেক্ষিতে যেন ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস বলে মনে হয়। সুটিয়া, ধানতলা, বানতলা যেমন বামফ্রন্টের শাসনের জনবিরোধী, অত্যাচারী রূপটি তুলে ধরেছিল, তেমনই সন্দেশখালি দেখাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের স্বরূপ। তবে সন্দেশখালিতে নারী-নির্যাতনের ঘটনাগুলির কারণ ও তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক পরের কথা। সর্বাগ্রে প্রয়োজন ওই মেয়েদের নিরাপত্তা, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ব্যবস্থা। সে বিষয়ে কতটুকু উদ্যোগ করা গিয়েছে? শেখ শাহজাহান ‘নিখোঁজ’ হলেও তাঁর দলবল এলাকায় যথেষ্ট সক্রিয়। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করছেন যে মেয়েরা, তাঁদের উপর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। শাসক দলের প্রতিনিধিরা যে ক্রমাগত অভিযোগকারিণী মেয়েদেরই কাঠগড়ায় তুলছেন, সর্বসমক্ষে তাঁদের ‘সাজানো’ বা ‘বিরোধী’ বলে দেগে দিচ্ছেন, এটা কেবল বিরক্তিকর নয়, ভয়ঙ্কর। অত্যাচারিত, সন্ত্রস্ত মেয়েদের গায়ে ‘মিথ্যাবাদী’ তকমা দিয়ে তাঁদের আরও বিপন্ন করে তোলা— এই রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলের দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয়? পুলিশও মেয়েদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি, কেবল নানা জনকে গ্রেফতার করছে, যা দলীয় প্রভাবের সন্দেহকে গাঢ় করছে।

বিরোধীদের ভূমিকাও উদ্বেগজনক। প্রকাশ্যে বা গোপনে সাম্প্রদায়িক বিভেদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা আর দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনৈতিক কৌশল। আর একটি কৌশল, সন্দেশখালির নিপীড়িত মেয়েদের বিজেপির নানা সভায় উপস্থিত করা হবে, বিজেপির সেই ঘোষণা। তৃণমূলের পার্টি অফিসে মেয়েদের যেমন মিটিং করতে বাধ্য করা হত, বিরোধী মঞ্চে মেয়েদের তোলা কি সেই রীতিরই আর এক পিঠ নয়? কোনও মেয়ের অনুমতি না নিয়ে তাঁর দেহ, শ্রম কিংবা বাক্যকে ব্যবহার করা চলে না, এই বোধ কবে হবে? ধর্ষণ এক গুরুতর অপরাধ, কিন্তু যে মানসিকতা থেকে মেয়েদের দলীয় মিটিং-মিছিলে উপস্থিত থাকতে, দলীয় নেতার কাজে বেগার খাটতে বাধ্য করা হয়, তা থেকেই যৌনসংসর্গে বাধ্য করা হয়। মেয়েদের দেহ-মন-বাক্যের উপর পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ভাঙাই রাজনীতির কাজ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sandeshkhali Incident Sandeshkhali Violence sandeshkhali Women Harassment Protest

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy