পর পর কতকগুলি মামলার গতিপ্রকৃতি দেখে ভারতীয় নাগরিকের মনে উদ্বেগ জন্মাতে পারে যে, প্রতিটিতেই তদন্তের ফাঁক দিয়ে গলে যেতে বসেছে ন্যায় ও নৈতিকতা। তালিকাটি ছোট নয়, তবে তার মধ্যেও মালেগাঁও মামলা হয়তো সর্বাধিক দুর্ভাগ্যজনক। ২০০৬ সালের মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণের মামলায় ১২ জন অভিযুক্ত বম্বে হাই কোর্টে প্রমাণাভাবে মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর পরই সেখানকার ট্রায়াল কোর্টে মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে ৭ জন অভিযুক্তের সকলকেই তদন্তের ‘অসম্পূর্ণতার কারণ’-এ মুক্তি দেওয়া হল। ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রে নাশিকের কাছে মালেগাঁও-তে শবে বরাত-এর দিন প্রার্থনা চলাকালীন বোমা বিস্ফোরণে ৪৫ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন, সকলেই সাধারণ নিরীহ নমাজপাঠরত মুসলমান। মামলা শুরু হতেই সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা ক্যামেরার সামনে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় নিজেদের ‘ভূমিকা’ স্বীকার করেছিলেন। ‘অভিনব ভারত’ গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের বিস্তারিত তথ্য রিপোর্টে উঠে এসেছিল। হিন্দু রাষ্ট্র সেনা প্রধান প্রমোদ মুথালিক বলেছিলেন তাঁরা কী করতে পারেন মালেগাঁও তার ‘সামান্য আভাস’মাত্র। অথচ তেরো বছর ধরে মামলা চলার পর অবশেষে কে বা কারা দায়ী, জানার আর কোনও পথই রইল না।
এমন ‘হাই-প্রোফাইল’ তদন্তে যে এত গাফিলতি সম্ভব, এত ‘ভ্রান্তি’ বা বিকৃত তথ্যপ্রমাণ সন্নিবেশিত হওয়া সম্ভব, তার পিছনে অবশ্যই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আছে। প্রশ্ন হল, সেই রাজনীতির ফাঁদ এড়ানো গেল না কেন? হিন্দু সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের পাকাপোক্ত অভিযানে একের পর এক সাক্ষীকে ভয় দেখিয়ে বা প্রভাবিত করে তাদের প্রাথমিক বয়ান পাল্টিয়ে নতুন ভাবে সাক্ষ্য দিতে প্রণোদিত করে মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া রোধ করা গেল না কেন? ভারতীয় গণতন্ত্রের অক্ষমতারই একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল মালেগাঁও মামলা। সন্দেহের অবকাশ নেই, এই তথাকথিত ‘সাফল্য’-এ এই বিশেষ নেটওয়ার্ক বর্তমানে ও ভবিষ্যতে আরও প্রসারিত ও ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠবে। বিচারবিভাগের উপর আস্থা রেখেও বলতে হয়, এই হিমালয়সমান গাফিলতি বা বাধাদানের কূটজাল যদি ভেদ করা না যায়, গণতন্ত্রের দায়পালনে দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
তদন্ত প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: বিষয়টি অতিপরিচিত, বহুচর্চিত। স্বাধীন ভারতে অসংখ্য বার দেখা গিয়েছে, কী ভাবে দলীয় রাজনীতির দীর্ঘ বাহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির অন্দরে প্রবিষ্ট হয়ে অপরাধীকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়, এমনকি বিচারবিভাগের চক্ষুকর্ণেন্দ্রিয়কেও গ্রাস করার প্রয়াস করে। তা সত্ত্বেও বলতে হয়, হিন্দুত্ব রাজনীতির বর্তমান অবতার যে ভাবে দ্বিধা-সংশয়-সম্মান সমস্ত বিসর্জন দিয়ে দাপটের সঙ্গে সেই রাজনীতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্দরে প্রতিষ্ঠিত করছে, তা অদৃষ্টপূর্ব। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে প্রজ্ঞা ঠাকুরের কথা। মালেগাঁও সন্ত্রাসের এই অতিপরিচিত অভিযুক্ত ভারতীয় জনতা পার্টির মনোনয়ন পেয়ে ভোপাল থেকে জিতে এসে জনপ্রতিনিধির উচ্চাসন অলঙ্কৃত করেছেন। জনসমক্ষে একাধিক বার ‘মুসলিম নিধন’-এর উদ্দেশ্যবিধেয় ব্যাখ্যা করেছেন, কিংবা গান্ধীঘাতক নাথুরাম গডসে-র মহিমা কীর্তন করেছেন। সুতরাং কেন বিচারাঙ্গনে দাঁড়িয়ে মালেগাঁও মামলার একের পর এক সাক্ষী নির্বিচারে ভুল সাক্ষ্য দেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কোনও একটি মামলায় যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলল না, বা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণপদ্ধতি দুর্বল থেকে গেল, এমন ঘটনা হামেশা ঘটে থাকে। কিন্তু সর্বসমক্ষে রাজনৈতিক জোর খাটিয়ে সন্ত্রাসের পক্ষে জনাবেগ সংগ্রহ করে কোনও হত্যাকাণ্ডের বিচার ধ্বস্ত করে দেওয়া হচ্ছে, এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী। দাবি উঠেছে এনআইএ আবার নতুন করে বিচারের জন্য আপিল করুক। তবে কিনা, ফলের আশা দূর অস্ত্— এই ভারতে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)