E-Paper

আইনের পথ

সালিশি সভায় মেয়েটির পরিবারকে হেনস্থা, টাকার প্রলোভন, হিংসার হুমকি, এগুলি আইনের পথকে অবরুদ্ধ করে দেয়। আলিপুরদুয়ারের সালিশি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়। এ বছরই অগস্টে মধ্যমগ্রামে এক নাবালিকার ধর্ষণের ঘটনা সালিশির মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা হয়।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:৫৮

আইন যতই কঠোর হোক, তার ফাঁস গলে কেবলই বেরিয়ে যেতে চায় নারী নিগ্রহকারী দুর্বৃত্তরা। সাম্প্রতিক অতীতে তা ফের দেখা গেল আলিপুরদুয়ারে এক নাবালিকার যৌন হেনস্থার পরবর্তী ঘটনায়। যৌন নির্যাতন থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র তৈরি করেছে ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস’ (২০১৯) বা ‘পকসো’ আইন, যা অপরাধীকে ন্যূনতম কুড়ি বছরের কারাবাস থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারে। অথচ, পরিবার স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানানোর পরেও বসানো হল সালিশি সভা, যেখানে এক পঞ্চায়েত সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। দশম শ্রেণির ওই ছাত্রীর পরিবারকে টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটমাট করতে চাপ দেওয়া হয়। পরিবারটি তাতে রাজি হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক। এ ধরনের ঘটনার পরে পুলিশ-প্রশাসন সংবাদমাধ্যমকে যে কথাটি বলতে অভ্যস্ত, তা হল, “আইন আইনের পথে চলবে।” কিন্তু সালিশি সভায় মেয়েটির পরিবারকে হেনস্থা, টাকার প্রলোভন, হিংসার হুমকি, এগুলি আইনের পথকে অবরুদ্ধ করে দেয়। আলিপুরদুয়ারের সালিশি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়। এ বছরই অগস্টে মধ্যমগ্রামে এক নাবালিকার ধর্ষণের ঘটনা সালিশির মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা হয়। এপ্রিলে বারাসত পুলিশ জেলার অধীন একটি এলাকায় এক চাষি পরিবারের নাবালিকা কন্যার ধর্ষণের পর স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরা নাবালিকার পরিবারকে আট লক্ষ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। মার্চে মালদহের ইংরেজবাজার এলাকায় এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে নিগ্রহের থানায় অভিযোগ না লেখানোর জন্য চাপ দেয় স্থানীয় পঞ্চায়েত, অভিযুক্ত ছিল স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের ছেলে।

এই ধারাবাহিকতা লক্ষ করলে মনে হয়, আইনের পথ ক্রমশ যেন থানা-আদালতের পথ ছেড়ে সরে আছে সালিশি-হুমকি-সমঝোতার পথে। এলাকায় যাঁরা প্রভাবশালী, ক্ষমতাসীন, তাঁরা দলমত-নির্বিশেষে দাঁড়িয়ে যান অভিযুক্তের পক্ষে। যাতে শাসকের ভাবমূর্তিতে আঘাত না লাগে, তার জন্য আক্রান্তকে নীরব করে দেওয়া, তাকে এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া, কখনও বা পরিবারের কাউকে দিয়ে প্রকাশ্যে ‘পুলিশের উপর আস্থা’ কবুল করিয়ে নেওয়া হয়। যেন অভিযুক্তের বিচার নয়, অভিযোগকে ধামাচাপা দেওয়াই ক্ষমতার উদ্দেশ্য। লক্ষণীয়, সংবাদে যে ঘটনাগুলি উঠে আসছে, সেগুলির ক্ষেত্রে শেষ অবধি অভিযোগ গ্রহণ করেছে পুলিশ, কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু প্রলোভন, ভীতিপ্রদর্শনের সামনে নতিস্বীকার করছে যে সব পরিবার, তাদের নিগৃহীত, ধর্ষিত মেয়েদের প্রতি অপরাধ আইনের বিচারের অধীনে আসছে না।

মেয়েদের প্রতি রাষ্ট্রের অপরাধ এমন ভাবেই ঘটে চলেছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার একটি অভিযোগের বিচারে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় যেমন প্রশ্ন তুলেছে, অভিযোগকারিণী বা অভিযুক্ত, কোনও পক্ষই ন্যায় পেল কি? ওই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এক অধ্যাপিকা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আইনের (পশ, ২০১৩) অধীনে অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগের আইন-নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ খারিজ করেছে সুপ্রিম কোর্ট, কিন্তু একই সঙ্গে রায় দিয়েছে যে, এই অভিযোগ ওই উপাচার্যের কর্মজীবন-সংক্রান্ত নথিতে উল্লিখিত হবে। আইনজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, এতে কোনও পক্ষের প্রতিই কি ন্যায় করা হল? এতে মহিলাও বিচার পেলেন না, অভিযুক্তও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেলেন না। অভিযোগের সময়সীমার বিষয়টি বিবেচনার প্রয়োজন— বহু ক্ষেত্রেই নিগৃহীতা ভেঙে পড়েন, কাজ হারানোর ভয় পান, মনোবল ফিরে পেতে সময় লাগে। অসহায়কে ন্যায় দিতে গেলে একই সঙ্গে কঠোর ও নমনীয় হওয়া প্রয়োজন আইন-আদালতের। রাষ্ট্রকে সেই কাজ করতে দিতে হলে চাই নারীর নিরাপত্তায় আগ্রহী রাজনীতি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Safety POCSO

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy