কে ভেবেছিল, বিহার নির্বাচনের তরীটি এসে ঠেকে যাবে যমুনার কালো জলে? নির্বাচনের আগেই ছটপূজা— প্রধানমন্ত্রীর নাকি বাসনা ছিল, সে উপলক্ষে যমুনায় ডুব দেবেন। শেষ অবধি তিনি আর আসেননি। দিল্লিতে বিরোধীপক্ষ বলছে, নদীর এমনই অবস্থা যে, প্রধানমন্ত্রী দূরস্থান, কারও পক্ষেই সে জলে নামা অতি বিপজ্জনক— প্রধানমন্ত্রী তাই পিছিয়ে গেলেন। গোটা ঘটনাটি নিয়ে রাজনৈতিক তরজা পেরিয়ে মূল সমস্যার দিকে তাকানো ভাল। দিল্লি-এনসিআর’এ যমুনার ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা সর্বজনবিদিত। যা তুলনায় কম চর্চিত, তা হল, উত্তর দিকে ওয়াজ়িরাবাদ বাঁধ পার করে দিল্লিতে প্রবেশ করামাত্র নদী দূষিত হতে আরম্ভ করে— এবং, দিল্লির পাশ দিয়ে যে ২২ কিলোমিটার পথ নদীটি যায়, তাতেই নদীর সমগ্র যাত্রাপথের মোট ৮০ শতাংশ দূষণ ঘটে। ২০২৪ সালে ভরা বর্ষাতেও দিল্লি-পরবর্তী পর্যায়ে যমুনার জলে ডিজ়লভ্ড অক্সিজেনের মাত্রা ছিল শূন্য। নদীতে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড (অর্থাৎ, নদীর জলে বিবিধ জৈব দূষককে দ্রাবিত করার জন্য বায়ুনির্ভর জীবাণুদের যত অক্সিজেন প্রয়োজন) ছিল নদীতে প্রাপ্য অক্সিজেনের তুলনায় অনেক বেশি; ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রাও ছিল অস্বাভাবিক রকম বেশি। যমুনা নামক নদীটি দিল্লিতে প্রবেশ করে কার্যত পরিণত হয় বর্জ্যবাহিনী নালায়। ঘটনা হল, এর পরও যমুনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ বিবিধ প্রয়োজনে এই নদীর উপরেই নির্ভরশীল— তাঁদের দুর্গতির কথাও সকলেরই জানা; ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকেই যমুনা বিষয়ে আদালতে একাধিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে, এবং চলেছে। তবে, প্রধানমন্ত্রীর ভোট-বাঞ্ছায় বিঘ্ন ঘটল এই প্রথম। যমুনাপাড় কি এ বার পরিবর্তনের আশা করতে পারে?
এত দিন কোনও চেষ্টাই হয়নি, তেমন দাবি করা যাবে না। দিল্লি সরকারের হিসাব অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ অবধি প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে যমুনার স্বাস্থ্যোদ্ধারে। নিকাশি নালায় দূষণ সংশোধন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, নিয়মিত সেই ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কুশলতা বৃদ্ধির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু, তার পরও যমুনা মৃতপ্রায়। এর কারণটি নিহিত নগর পরিকল্পনার সামগ্রিক ব্যর্থতায়। দিল্লির ক্ষেত্রে এমন বহু এলাকা রয়েছে, যা পরিকল্পিত নিকাশি নালা ব্যবস্থার বাইরে। সেখানে শৌচাগারের জল সরাসরি এসে মিশছে বৃষ্টির জল নিকাশির খালে, এবং সেই জল সরাসরি পৌঁছচ্ছে যমুনায়। রয়েছে বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল, যার দূষিত জল কার্যত কোনও সংশোধন ছাড়াই মিশছে যমুনায়। কথাগুলি দিল্লির নগরকর্তাদেরও বিলক্ষণ জানা। তার পরও সমস্যা অব্যাহত। তার একটি কারণ ভারতীয় ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্নীতি— যেখানে নির্দিষ্ট কাঞ্চনমূল্যে দূষণ করার ‘অধিকার’ কিনে নেওয়া যায়। অন্য কারণটি হল, নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে বাইরে থেকে যান ‘অপর’রা— কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা জবরদখল জমির বাসিন্দা, কোথাও বস্তিবাসী, কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রেই শহরের ‘নিজস্ব নাগরিক’-এর চেয়ে পৃথক। শহর তাঁদের কথা ভাবে না। ফলে, যেখানে যমুনাপাড়ের বস্তিতে যথাযথ শৌচাগার ও নিকাশি থাকলে নদীর দূষণ খানিক হলেও কমত, সেখানেও থাকে শুধু অবহেলা। শহরকে তার জৈব চরিত্রে স্বীকার করতে না-পারলে এর থেকে নিস্তার নেই। অর্থাৎ, প্রশ্নটি শেষ অবধি শুধু প্রযুক্তি বা কারিগরির নয়, রাজনীতির। সদর্থক রাজনীতি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)