ভারতীয় গণতন্ত্র এখন এক বিরাট অস্তিত্বগত পরীক্ষার সামনে— এবং সেই পরীক্ষায় ফেলেছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন নিজেই। ইতিহাসের পরিহাস বলতে হবে যে, সবচেয়ে গুরুতর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অর্থাৎ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে গণতান্ত্রিক দেশের যে প্রতিষ্ঠান, তারই অভিভাবকত্বে গণতন্ত্রের অর্থ পাল্টে যেতে বসেছে। অসংখ্য, অগণ্য দেশবাসী ভোটাধিকার হারাতে পারেন, এমন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিহারে ভোটের আগে নিবিড় সমীক্ষায় ভোটার তালিকা সংশোধন চলছে, স্থির হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও সেই পদ্ধতি শুরু হবে শীঘ্রই। প্রশ্ন অনেকগুলি। প্রথম প্রশ্নটিই এই সমীক্ষার সময় নির্বাচন নিয়ে। কেন এত জরুরি একটি প্রক্রিয়া এত তাড়াহুড়ো করে বিহারের ভোটের আগে সে রাজ্যে চালু করা হল, তার পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখছেন অনেকেই। বিহারের ভোটার তালিকায় প্রায় ৮ কোটি মানুষ, যাঁদের মধ্যে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় নাম না থাকার কারণে অন্তত ৪ কোটিকে নতুন করে ভোটার হিসাবে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে নির্দেশমতো ফর্ম ও নথি জমা দিতে না পারলে ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা যাবে। এই মুহূর্তে দশটি বিরোধী দল সুপ্রিম কোর্টে মামলা করায় গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরাই মন্তব্য করেছেন যে, এই সময়সীমা মান্য করা ভয়ঙ্কর কঠিন, তাঁরা নিজেরাও হয়তো যথাসময়ে নথি জমা দিতে অপারগ হতেন। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে এ কাজে অগ্রসর হতে বাধাদান না করলেও এমন কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করেছে যাতে তৈরি হয়েছে কমিশনের পুনর্বিবেচনার অবকাশ। নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রশ্নে নথি নিয়ে কোনও সমস্যা উপস্থিত হলে আদালতই ভরসা, অথচ নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেলে আদালতের হস্তক্ষেপ অসম্ভব। তাই, এত কম সময়সীমা কেন— সদুত্তর চেয়েছেন মহামান্য বিচারপতিরাই।
কেনই বা বর্তমান ভোটারদের ভোটাধিকার নিয়ে সংশয় এত বড় আকার নিল— দ্বিতীয় প্রশ্ন। বিরোধীদের আক্রমণ: তা হলে কি দেশের বর্তমান সাংসদরা অবৈধ ভোটে জিতেছেন? নিবিড় সংশোধনের প্রয়োজন বিষয়ে কোনও আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই এমন একটি গুরুতর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় প্রক্রিয়াটির নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত যখন জানা আছে গত বছর মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিপুলসংখ্যক ভোটারের নাম যুক্ত হয়েছিল ঠিক ভোটের আগেই। নির্বাচন কমিশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, দ্রুত নগরায়ণ, অভিবাসন, মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকায় থেকে যাওয়া ইত্যাদির কারণেই ভোটারতালিকা সংশোধনের প্রয়োজন। প্রতিযুক্তিটি হল, এ সব যে-হেতু সাধারণ ঘটনা, সার্বিক ভাবে ক্রিয়াশীল, কোনওটিরই হঠাৎ পরিবর্তন হয়নি, নিবিড় সংশোধনেরও আশু প্রয়োজনীয়তা সহজবোধ্য নয়।
কমিশনের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। নির্বাচন কমিশনকে ভারতীয় সংবিধান ভোটার তালিকা তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কাজটি হচ্ছে, তা করার অধিকার কমিশনের আছে কি না, প্রশ্ন সেখানেই। সুপ্রিম কোর্ট ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে কমিশনকে কোনও বাধা দেয়নি, তবে কে নাগরিক আর কে নাগরিক নয়, তা যাচাইয়ের প্রশ্নে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তটি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলেছে। কোন নথি নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বিবেচ্য, তা স্থির করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়— মনে করিয়ে দিয়েছেন বিরোধী মুখপাত্ররা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চের মতে, এ বিষয়ে কমিশনের ক্ষমতা খতিয়ে দেখা হবে। তবে কি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরিতেই নেমে পড়েছে ভারতীয় সরকার? বড় রকমের বিপদ ঘনিয়েছে: বিরোধীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখনই বিষয়টির সমাধান করুক কেন্দ্র।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)