E-Paper

আগুন নিয়ে খেলা

কেউ বলতে পারেন, সংঘাতটি যেখানে স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক, তাকে আর নতুন করে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার কী থাকে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গোলমালের সূত্রপাত সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন ঘিরেই; এবং, যারা গোলমালটি পাকিয়েছে, তাদেরও ধর্মীয় পরিচিতি স্পষ্ট।

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৩০

অধুনা-বিস্মৃত চলচ্চিত্র পিএম নরেন্দ্র মোদী-তে (২০১৯) একটি সংলাপ ছিল: ২০০২ দাঙ্গার পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে নামচরিত্রের অভিনেতা কাঁদো-কাঁদো ভঙ্গিতে বলছেন, “মেরা গুজরাত জল রহা হ্যায়”। সংলাপ রচয়িতা জানতেন, নামভূমিকার চরিত্রটির বাস্তব যা-ই হোক না কেন, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে কোনও নেতার মুখে সংলাপ বসাতে হলে তাতে গোটা রাজ্যের কথা থাকাই বিধেয়, কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মের জনগোষ্ঠীর কথা নয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা এই কথাটুকুও ভুলেছেন। যেমন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক অশান্তিতে মৃত দুই ব্যক্তির শবকে তাঁরা রাজনীতির আয়ুধ বানিয়ে তুলেছেন— তাঁদের দলীয় পরিচিতির ভিত্তিতে নয়, ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে। অবশ্য, শুধুমাত্র মৃতদেহের দাবিই নয়, মুর্শিদাবাদের ঘটনার রাজনৈতিক ব্যবহারে বিজেপির ভাষ্য আগাগোড়াই ধর্মীয়। প্রমাণ, দলের রাজ্য সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের সমাজমাধ্যমে একের পর পোস্ট। তিনি স্বঘোষিত ভাবেই ‘হিন্দু’দের স্বার্থরক্ষা করতে নেমেছেন, এবং প্রতিপক্ষ হিসাবে রাজ্য সরকারকে খাড়া করেছেন মুসলমানদের স্বার্থরক্ষাকারী হিসাবে। দেশের প্রধানতম দলের রাজ্য সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে তাঁর এক বারও মনে হয়নি যে, অন্তত মুখে ধর্মনির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের স্বার্থরক্ষার কথা বলা তাঁর গণতান্ত্রিক কর্তব্য। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক সংঘাতকে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নিন্দনীয়।

কেউ বলতে পারেন, সংঘাতটি যেখানে স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক, তাকে আর নতুন করে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার কী থাকে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গোলমালের সূত্রপাত সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন ঘিরেই; এবং, যারা গোলমালটি পাকিয়েছে, তাদেরও ধর্মীয় পরিচিতি স্পষ্ট। কিন্তু, প্রশ্ন হল: সত্যিই কি মুর্শিদাবাদের এই অঞ্চলগুলিতে এক ধর্মের সব, বা নিদেনপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অন্য ধর্মাবলম্বী সব মানুষের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে তাঁদের আক্রমণ করেছে? রাজনীতির ঘোরকৃষ্ণ চশমায় চোখ ঢাকা না-থাকলে এমন দাবি কেউ করবেন না। শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, এই রাজ্যের সর্বত্র হিন্দু এবং মুসলমান শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করে— কোনও ধর্মের সাধারণ মানুষের হাতেই অপর ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ বিপন্ন নয়। যে কোনও অশান্তিকে দমন করাই প্রশাসনের কর্তব্য, নাগরিক সমাজের কর্তব্য। সাম্প্রদায়িক কারণে অশান্তি হলেও তাকে অবশ্যই কঠোর হাতে দমন করতে হবে, দুষ্কৃতীদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলি যদি সেই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনকে সাহায্য করে, তা অতি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে কোনও একটি রাজনৈতিক দল যদি কোনও বিশেষ ধর্মের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠতে চায়, এবং তার জন্য সামূহিক বিপন্নতার কথা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তা এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।

বিভাজনের রাজনীতিতে বিজেপির সিদ্ধি সুপ্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গেও এই আগুন নিয়ে তারা দীর্ঘ দিন ধরে খেলছে। সমাজমাধ্যমের দৌলতে মিথ্যা প্রচারের কাজটি এখন জলবৎ। শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, একাধিক ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিশিষ্ট নাগরিক’ এখন সেই মিথ্যার বেসাতিতে মেতেছেন— ভুয়ো ছবি, মিথ্যা বয়ান প্রচার করে চলেছেন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা বিপন্ন, এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মেরুকরণের রাজনীতিতে তাঁদের সুবিধা হবে। অনুমান করা চলে যে, বঙ্গীয় নেতারা স্বরাট নন— উপর মহলের অনুমতি এবং সমর্থন না থাকলে তাঁরা এতখানি বেড়ে খেলতেন না। তবে, ভোটের স্বার্থে তাঁরা গোটা রাজ্যকে অগ্নিগর্ভ করে তুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না, এ কথাটি রাজ্যবাসীও নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Murshidabad WAQF Amendment Act Religious Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy