একদা বাঙালির শিক্ষা ও রুচিবোধ সারা ভারতের গর্ব ও প্রশংসার কারণ ছিল। ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে আগামী কাল’ জাতীয় প্রবাদপ্রতিম বাক্যের বিস্তার তারই মুগ্ধ বহিঃপ্রকাশ। তার পর দিন পাল্টেছে, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে, বাঙালিও সেই আগের মতো আছে কি? অন্তত তার সামাজিক আচরণ আর তার প্রমাণ দেয় না। সম্প্রতি জানা গেল, লোকাল ট্রেনে এক জন মানুষকে সহযাত্রীরা চরম হেনস্থা করেছে কেবল তিনি সংখ্যালঘু বলে। কাজের দিনের সকালে শিয়ালদহগামী ডাউন ট্রেনটিতে প্রায় দশ-বারো জন ট্রেনযাত্রী মানুষটির দাড়ি ও টুপি নিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক’ কথা বলতে শুরু করে, এক পর্যায়ে প্রতিবাদ করলে মারধর করে আসন থেকে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে তুলে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। এই সবই জানা গিয়েছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, সমাজমাধ্যমে জনৈকের একটি পোস্টের সূত্রে— জিআরপি বা আরপিএফ-এর কাছে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। পুলিশ পরে খোঁজখবর করলেও, যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি আক্রান্ত মানুষটির সঙ্গে।
অপমান-অবমাননার ‘লজ্জা’ মানুষ জনসমক্ষে আনতে চায় না, আক্রান্ত মানুষটিও চাননি। পুলিশে অভিযোগ দায়ের না করা তারই প্রমাণ। কিন্তু লজ্জা কি তাঁর হওয়ার কথা? সে তো হওয়ার কথা হেনস্থাকারীদের— প্রকাশ্য দিবালোকে বিনা প্ররোচনায় যাঁরা ওই অমানবিক কাজ করলেন। আবার বৃহত্তর বিবেচনায় এই লজ্জা কি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের, সমস্ত বাঙালির নয়? নিছক উত্তেজিত বা উগ্র ট্রেনযাত্রী-জনতা তথা ‘মব’-এর আচরণ বলে এই ঘটনাটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়— লোকাল ট্রেন আজ নতুন চলছে না, সেখানে সংখ্যালঘু বেশভূষার চিহ্নধারী মানুষের যাতায়াতও আজকের নয়, কিন্তু সহযাত্রীদের এমন হিংস্র আচরণও আগে দেখা গেছে কি? জন-আচরণে অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গবাসী কথায় কথায় ভিন রাজ্যের উদাহরণ দেন, বিহার উত্তরপ্রদেশ দিল্লি হরিয়ানায় পথেঘাটে মানুষ কত ‘অসভ্য’ ও ‘অশিক্ষিত’ তা নিয়ে তাঁদের অভিযোগের শেষ নেই। এর বিপ্রতীপে বাঙালির চেতনে-অবচেতনে দৃঢ়প্রোথিত এই বিশ্বাস কাজ করে এসেছে যে, বাঙালি জাতিচরিত্র উদার, সহিষ্ণু— তার বিদ্যা ও সুরুচির চর্চা তাকে জাতি বর্ণ ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে বৈষম্যহীন হতে শিখিয়েছে, লোকব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অপছন্দ সরিয়ে উদার হতে শিখিয়েছে। লোকাল ট্রেনের ঘটনাটি কিন্তু ভিন্ন-চিত্র তুলে ধরল।
কেউ বলতে পারেন, এর জন্য দায়ী সেই সব রাজনৈতিক দল, ধর্ম-রাজনীতির অস্ত্রে যারা সমাজমন বিষিয়ে তুলছে। কেউ বলবেন, হিন্দু-মুসলমান দ্বৈরথ বঙ্গমনে এমন এক স্পর্শকাতর জায়গা যা একুশ শতকেও সমাজ-মনস্তত্ত্ব থেকে মোছার নয়, ট্রেনের ঘটনাটি তারই প্রকাশ। কেউ কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এই সময়কে: আধুনিক জীবন-মনের অস্থিরতাই হিংস্র দাঁতনখ বার করছে। এই সবই হয়তো সত্য, কিন্তু তারও বেশি সত্য— ধর্মীয় রাজনীতিই হোক বা দ্বিজাতি তত্ত্বের আঘাত, বাঙালি একদা সব কিছুর মোকাবিলা করেছে। সে আঘাত পেয়েছে, ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হয়েছে কিন্তু বাইরে সমাজ-আচরণে কখনও অনুদার হয়নি, হিংসা থেকে যথাসম্ভব বিরত থেকেছে— প্ররোচনার ব্যতিক্রমগুলি ছাড়া। এ-ই তার সভ্যতা, বিশিষ্টতা। লোকাল ট্রেনে শুধু সংখ্যালঘু মানুষটি নন, এই জাতিচরিত্রও আক্রান্ত হল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)