উত্তরবঙ্গের যে নদীমাতৃক, সুজলা রূপটির সঙ্গে আজন্ম পরিচিত রাজ্যবাসী, গবেষণায় দেখা গিয়েছে তারই আড়ালে নাকি তলে তলে জমাট বাঁধছে অন্ধকার। হিমালয়ের পাদদেশের নদীগুলি বর্ষার দিনে পাগলপারা। প্রবল বৃষ্টির পরই ফুঁসে উঠে ভাসিয়ে দিচ্ছে জনপদ, নির্বিচারে ভাঙছে রাস্তা, বিপর্যস্ত করে তুলছে স্থানীয় অর্থনীতি। কিন্তু, এই রূপ তার চিরস্থায়ী নয়। বরং গবেষণা বলছে, রায়ডাক, তিস্তা, মহানন্দা, কোশীর মতো নদী ক্রমশই শুকিয়ে আসছে। বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সমগ্র অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, জীবিকা, এমনকি জলের জোগানকেও। অদ্ভুত বৈপরীত্যই বটে। রিমোট সেন্সিং, জিআইএস টুল-সহযোগে পরিচালিত এই গবেষণায় যে তথ্য মিলেছে, তা এ রাজ্যের উত্তর ভাগের বাসিন্দাদের পক্ষে বিপদবার্তা স্বরূপ। নদী শুধুই পর্যটনস্থল নয়, নৌকাবিহার-সহ প্রমোদের জায়গাও নয়। একটি বহতা নদী এক বিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিকে, বাসিন্দাদের দৈনন্দিনতাকে, সংস্কৃতিকেও ধারণ করে রাখে। তাই তার মৃত্যুসঙ্কেত এক বিরাট ছন্দপতনের সূচনা করে। তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সহজ কথা নয়।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই অঞ্চলের নদীর মরসুমি জলধারণের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তার কারণটি লুকিয়ে সমগ্র অঞ্চলের বদলে যাওয়া ভূপ্রকৃতির মধ্যে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৪-এর মধ্যে এখানে জলাভূমি হ্রাস পেয়েছে ৫,৪০০ একর; ছোট পুকুর ইত্যাদি হ্রাস পেয়েছে ৫,২০০ একর; বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১৩,৭০০ একর। অন্য দিকে, চাষের জমি, জনবসতির বিস্তার বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। পাশাপাশি লক্ষণীয় পরিমাণ পরিত্যক্ত নদীখাত হয় চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে, নয়তো তাতে বসতি গড়ে উঠেছে। এই নদীখাতগুলিই একদা জল সঞ্চয় এবং জীববৈচিত্রের প্রাণকেন্দ্র ছিল। এগুলিতে দখলদারি ভূপ্রকৃতির ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতির সূচনা করেছে। তবে উত্তরবঙ্গের নদীগুলির দুরবস্থা আগেই উপলব্ধি করা গিয়েছিল। জলপাইগুড়ির করলার মতো বহু ছোট নদী ইতিমধ্যেই দূষণের ভারে মজে যাওয়ার পথে। বেআইনি ভাবে নদী থেকে বালি-পাথর তুলে নেওয়ার ফলেও প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত নদীখাত। অথচ, সমগ্র বিষয়ে প্রশাসন আশ্চর্য নীরব। উদাসীনতার সূত্রপাত বাম আমল থেকেই। তিস্তার বিকল্প হিসাবে মহানন্দার জলকে ব্যবহারের উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল তখনই। কিন্তু দূষণভারে ধুঁকতে থাকা মহানন্দার দূষণমুক্তির কাজটি অসম্পূর্ণই থেকেছে। বেপরোয়া নগরায়ণ এবং জমতে থাকা আবর্জনার ভারে মহানন্দা ক্রমেই শুষ্কতর ক্ষীণকায়া হয়ে উঠেছে। গত বছর তিস্তার গজলডোবা বাঁধ মেরামতি কালে মহানন্দার জলকে পরিস্রুত করে শিলিগুড়িতে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দূষণের ধাক্কায় সেই সিদ্ধান্তও পত্রপাট বাতিল করতে হয়।
সমস্যা শুধু উত্তরবঙ্গের নদীগুলিরও নয়। নদীবিধৌত বঙ্গের সমস্ত নদীই তীব্র দূষণ ও পলিমুক্তির কাজে সরকারি শৈথিল্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। দক্ষিণবঙ্গে তীব্র গরমে গঙ্গার জলস্তর যে উদ্বেগজনক ভাবে কমছে, তার জন্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণ দায়ী নয়। বহু কোটি টাকা ব্যয়েও গঙ্গার জলকে কলুষমুক্ত করা যায়নি। এমনই চলতে থাকলে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে জলের জন্য হাহাকার তীব্রতর হবে। গত বছর শিলিগুড়ির জলসঙ্কট তার সামান্য নমুনা দেখিয়েছিল। এ বার কি তবে দক্ষিণের পালা?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)