E-Paper

তত্র কা পরিদেবনা

সাহিত্যের নোবেলজয়ীর নামটি ঘোষণা হতে বাঙালি মানসে বিমিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে। এমনিতে নোবেলের নানা বিভাগে মনোনীতদের তালিকাটি পরবর্তী পঞ্চাশ বছর গোপন থাকা নিয়ম।

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৫১

বাঙালির সব কিছুতেই মুশকিল। তার পছন্দের লোক নোবেল পেলে সহ-বাঙালি বলবে, অমুক কেন পেলেন না, তিনি তো ঢের বেশি দাবিদার! আর পছন্দের লোক নোবেল না পেলে তার নিজেরই যেন সম্মানহানি, অস্তিত্বসঙ্কট, জীবন-মরণ সমস্যা। এমনিতে বিজ্ঞানের নোবেল— চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন নিয়ে তার তত উৎসাহ নেই কারণ সে জানে, বিজ্ঞানের যে দুরূহ তত্ত্ব ও প্রয়োগ নোবেল-অঙ্গনে সম্মানিত হল, তা নিয়ে তর্ক করতে গেলে হাতে স্রেফ অনেকটা সময় থাকাটাই যথেষ্ট নয়, অধিকার-অনধিকার চর্চা বলেও একটা ব্যাপার আছে। অর্থনীতির বিষয়েও এ কথাটা বহুলাংশে সত্য। হাতে রইল সাহিত্য ও শান্তির নোবেল— এই দু’টি বিষয়ে বাঙালিকে তর্কে হারাতে পারে, এমন দ্বিতীয় জাতি সম্ভবত দুনিয়ায় মিলবে না। চায়ের দোকানেই হোক, বাসে কি মেট্রোয় অচেনা সহযাত্রীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তর্কে বা বন্ধু-পরিচিতজনের আসরে, তার খোশগল্পের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে ঘরের ও বাইরের সাহিত্য নিয়ে তার আপাত-অসীম জ্ঞানপ্রদর্শন, সেই সঙ্গে বিশ্বের রাজনীতি, যুদ্ধ-সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিশ্ব শান্তি’ নিয়ে তার একান্ত নিজস্ব তত্ত্বপ্রচার। ইদানীং সমাজমাধ্যম একাধারে হয়ে উঠেছে তার পছন্দের চণ্ডীমণ্ডপ এবং কলতলা: সেখানে চোখ রাখলেও এর ভূরি প্রমাণ মিলবে।

এ বছর বিশেষ করে সাহিত্যের নোবেলজয়ীর নামটি ঘোষণা হতে বাঙালি মানসে বিমিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে। এমনিতে নোবেলের নানা বিভাগে মনোনীতদের তালিকাটি পরবর্তী পঞ্চাশ বছর গোপন থাকা নিয়ম। তবে সাহিত্যে নোবেলের ক্ষেত্রে প্রতি বছরই বিশ্ব জুড়ে প্রচারমাধ্যমে এক রকম উত্তেজনার ধুয়া ওঠে, কয়েকটি নাম হাওয়ায় ভাসতে থাকে, এমনকি বিশেষজ্ঞ ‘বুকমেকার’ তথা বাজি-লড়িয়েদের বিচারে কোন লেখক অন্যদের থেকে এগিয়ে আছেন সে খবর চাউর হতে থাকে, সেই সূত্র ধরেই বাঙালি পাঠককুলও আশায় বুক বাঁধতে থাকেন। এ বছরও আশার বেলুনটি ফুলছিল, কারণ ‘সম্ভাব্য নোবেলজয়ী’ তালিকায় বিশ্রুত দুই কানাডীয় ও জাপানি লেখকের পাশাপাশি ‘ঘর’-এরই দুই লেখকের কথাও ব্যাপক ভাবে শোনা যাচ্ছিল: এক জন প্রবল জনপ্রিয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক, আর এক জন তো পুরোদস্তুর বাঙালি। হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাজ়নাহর্কাই-এর নোবেলজয় এই বেলুন এক প্রকার চুপসে দিল বলা চলে, ঠিক যেমনটা গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হান কাং-এর সময়েও হয়েছিল। এ বছর প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশটি দ্বিবিধ: এক দিকে প্রত্যাশিত লেখকের ভাগ্যে নোবেলের শিকে না ছেঁড়ার আক্ষেপ-হতাশা, অন্য দিকে সংখ্যাগুরু পাঠকের প্রায়-অচেনা এক লেখকের প্রতি ধাবিত বিস্ময়, প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গও— তাঁর দুরুচ্চার্য নামটি নিয়ে, কয়েক দশকব্যাপী বিস্তৃত লেখকজীবনে তাঁর হাতে গোনা উপন্যাস-সংখ্যা নিয়ে, এবং সর্বোপরি— রবীন্দ্রনাথের নোবেলজয়ের পর এই ১১২ বছরে বাংলার কত প্রতিভাধর লেখক-লেখিকা নোবেল প্রাপ্তির যোগ্য দাবিদার ছিলেন অথচ পাননি, সেই তুলনাটি নিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই দ্বিতীয় স্বরটি ব্যঙ্গ থেকে ক্রোধে উতরাতে আদৌ সময় লাগছে না; বহু লেখকও রাগে-দুঃখে কপাল ঠুকছেন, বাঙালির প্রতিভার দর কেউ দিল না বলে।

আত্মকরুণা কিছু ক্ষেত্রে ভাল, কিন্তু আত্ম-সমালোচনা সর্বক্ষেত্রে কাজের। দ্বিতীয় আয়নাটির সামনে নিয়মিত দাঁড়ানোর অভ্যাস করলে সে বুঝতে পারত, অচেনা এক দেশ ও ভাষার নোবেলজয়ে আজ যে আহত, সে-ই একদা বিশ্বের নানা ভাষার ধ্রুপদী ও সমকালীন সাহিত্যপাঠে কত মনোযোগী, শ্রদ্ধাশীল ছিল। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, রুশ ইত্যাদি তো বটেই, এশিয়া ও ইউরোপের অন্য বহু ভাষা-উপভাষার সাহিত্যচর্চাও সে করে এসেছে দীর্ঘকাল; যেখানে মূল ভাষা শেখা দুষ্কর হয়েছে, সেখানে হাত ধরেছে অনুবাদের; তা বলে অচেনা সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, অবহেলা-উপেক্ষার প্রশ্নই আসে না। এবং এই সব কিছুই সে করেছে মাতৃভাষা-সাহিত্যের আন্তরিক সেবার সমান্তরালে, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের চর্চা নিয়ে সে যেমন হীনম্মন্যতায় ভোগেনি, তেমনই পরস্মৈপদী সাহিত্যগৌরবেও লালায়িত হয়নি। সাহিত্যচর্চার এ-ই প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা, যাতে সে একদা স্থিত ছিল। সেই জায়গাটি সে কোন দোষে হারাল, কেনই বা সে ইদানীং কার্যক্ষেত্রে নিজের ভাষা-সাহিত্যের প্রতি বিমুখ অথচ ভিনদেশি সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিতুলনায় নিতান্ত বারফট্টাই-সর্বস্ব, সেই প্রশ্নটি আজ তার নিজেকেই করা দরকার। নোবেল তো নিমিত্তমাত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Literaure Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy