ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন ভারতে এর আগেও অনেক বার হয়েছে। তাকে ঘিরে এই পরিমাণ আতঙ্ক, একাধিক মানুষের আত্মহত্যা— এমনটা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এ বারে যে দেখা যাচ্ছে, তা কার্যকারণসম্পর্ক-বিহীন নয়। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে এই ভয়ের গুরুত্ব বিপুল; এবং, এক পক্ষ সেই অস্ত্র ব্যবহার করলে অপর পক্ষের হাতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তা ব্যবহারের সুযোগ চলে আসে। যেমন, বিজেপি গোড়া থেকেই এসআইআর-কে ভয়ের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে বলে স্থির করে নিয়েছে। দলের শীর্ষ নেতা থেকে পাড়া স্তরের খুচরো নেতা, প্রত্যেকের বয়ান এক— প্রথমে ভোটার লিস্ট থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে, এবং তার পর দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে। কাদের নাম বাদ পড়বে, আর কারা তাদের দেশ থেকে বার করে দেবে, শীর্ষ নেতারা এ সব প্রশ্নের উত্তরে নামমাত্র ধোঁয়াশা রাখেন, রাজ্য বা পাড়া স্তরের নেতারা সেই আবডালটুকুরও তোয়াক্কা করেন না— কিন্তু, বুঝে নিতে কারও সমস্যা হয় না যে, মুসলমানদের নাম বাদ পড়বে, এবং সেই মুসলমানদের তাঁরাই দেশের সীমান্ত পার করিয়ে দেবেন। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অন্তত ২৮ শতাংশ মুসলমান, ফলে এ রাজ্যে এ-হেন হুমকি আতঙ্ক তৈরি করবে, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণ নেই।
কিন্তু, মুসলমানদের মনে ভীতির সঞ্চার এই রাজনৈতিক হুমকির প্রধান উদ্দেশ্য, এ কথা ভাবলে সম্ভবত ভুল হবে। মুসলমানদের সিংহভাগ এমনিতেও বিজেপির ভোটার নন বলেই অনুমান করা চলে। এ ক্ষেত্রে, এই ভীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য আসলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে ইঙ্গিত দেওয়া— কারা দেশকে ‘মুসলমান-মুক্ত’ করতে চাইছে, আর কারা সেই মুসলমানদের ‘তোষণ করছে’, তা স্পষ্ট করে দেওয়া। সমস্যা হল, অসমের এনআরসি-ই হোক বা বিহারের এসআইআর, সব ক্ষেত্রেই যে মুসলমানদের চেয়েও গরিব হিন্দুরা বেকায়দায় পড়ছেন বেশি, তা স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গেও তথাকথিত নিম্নবর্ণের বহু মানুষ এসআইআর-এর নথি দেখাতে ব্যর্থ হবেন বলে আশঙ্কা। শান্তনু ঠাকুরের মতো সাংসদ যে ভঙ্গিতে তাঁদের আশ্বস্ত করতে চাইছেন, বিপদ এবং ভীতির চরিত্র তাতেও স্পষ্ট। এসআইআর ঘোষণার পর যত জন আতঙ্কে আত্মঘাতী হয়েছেন, তাঁদেরও বেশির ভাগ হিন্দু। তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক এই ভীতিরই সুযোগ নিচ্ছে। এসআইআর নিয়ে মিছিল করে দলের শীর্ষ নেতারা এক দিকে আত্মহত্যার সংখ্যা গুনছেন, আর অন্য দিকে মানুষকে ‘কোনও ভুল সিদ্ধান্ত’ নিতে বারণ করে বলছেন, তাঁরা পাশে আছেন। অর্থাৎ, এই ভীতিটি তাঁদেরও প্রয়োজন— কারও রক্ষাকর্তা হিসাবে স্বীকৃতি পেতে গেলে প্রথমে তাঁর বিপন্ন হওয়া জরুরি কিনা! ফলে, বিজেপি যে আতঙ্ক তৈরি করে রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলতে চায়, তৃণমূল কংগ্রেসের কাছেও তা একই রকম লাভজনক।
সে কারণেই, ভয়টিকে কেউ ভাঙতে চান না। এত বার যে এসআইআর হয়েছে বিন্দুমাত্র হইচই ছাড়াই, তাকে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রবল আতঙ্কের বিষয় করে তোলার পর বিজেপি যে সেই ভয় ভাঙতে চাইবে না, তা সহজবোধ্য। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ভয় ভাঙানো। এ রাজ্যে তারা বৃহত্তম দল, সবচেয়ে বিস্তৃত ও গভীর সংগঠনও তাদেরই। সেই সংগঠন ব্যবহার করে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, তাঁদের কাগজপত্র গোছাতে, অথবা জোগাড় করতে সাহায্য করা যায়। কারও নাম ভোটার তালিকায় না থাকলে তাঁর কী কর্তব্য, সে বিষয়ে মানুষকে বুঝিয়ে বলা যায়, তাঁদের পাশে থাকা যায়। তার বদলে জনসভা থেকে মৃতদেহের সংখ্যা গুনে, এবং রক্ষাকর্তা হওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাঁরা এই ভয়ের থেকে লাভ তুলতে ব্যস্ত। উভয় পক্ষের স্বার্থই পরিষ্কার, এবং কোনওটিই মানুষের পক্ষে ইতিবাচক নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)