ফাঁকিবাজ ছাত্ররা যেমন একটি প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে বসে, এবং যে কোনও প্রশ্নেই সেই উত্তর লিখে আসে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তেমনই জওহরলাল নেহরুর নাম মুখস্থ করে রেখেছেন। সংসদে পহেলগাম হামলা এবং অপারেশন সিঁদুর নিয়ে বলতে উঠেও তিনি ১৪ বার নেহরুর নামোল্লেখ করলেন। তাতেই পরীক্ষার খাতা ভরে গেল, ফলে যে প্রশ্নগুলি সত্যই এসেছিল, তার একটিরও উত্তর মিলল না। যেমন, জানা গেল না যে, সত্যিই কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ-পরিস্থিতি এড়ানো গেল? বিরোধীদের চাপাচাপি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করলেন না— বললেন, বাইরের কেউ হস্তক্ষেপ করেননি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২৯ বার যে দাবিটি করেছেন, সেটি যদি আদ্যন্ত মিথ্যা হয়, সংসদে দাঁড়িয়ে সে কথা স্পষ্ট ভাবে বলা উচিত ছিল না কি? জানা গেল না যে, অপারেশন সিঁদুরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং কেনই বা তা ঠেকানো গেল না? প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বিরোধীদের পরামর্শ দিয়েছেন, এ সব প্রশ্ন না করে বরং তাঁরা জানতে চান, পাকিস্তানের কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হল। দু’টি প্রশ্নের উত্তর এক সঙ্গে দেওয়া যাবে না, সংসদে এমন কোনও শর্ত ছিল কি? কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা প্রশ্ন করেছেন, ২৬/১১-র হামলার দায় নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করে থাকেন, তা হলে অমিত শাহ এখনও তাঁর পদে আসীন রয়েছেন কেন? স্বভাবতই এই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি।
তবে, পরীক্ষায় ফাঁকিবাজ ছাত্রের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর একটি মোক্ষম ফারাক আছে— তাঁর খাতা দেখা হয় না, তিনি পরীক্ষায় বসলেই পাশ। সে কথা তিনিও বিলক্ষণ জানেন। ফলে, সংসদের আলোচনাটিকে তিনি নিয়ে গেলেন অতলে। কংগ্রেসকে ‘পাকিস্তানের সমব্যথী’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া নিতান্ত নিম্ন স্তরের রাজনীতি— কিন্তু, তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হল কংগ্রেসের তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের প্রবণতার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি সদয় হওয়ার অভিযোগকে জুড়ে দেওয়া। ভারতীয় মুসলমান এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মধ্যে সরলরৈখিক সম্পর্ক প্রদর্শনের প্রবণতাটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মজ্জায় রয়েছে। কিন্তু, সংসদের পরিসরে, দেশের উচ্চতম আসন থেকে, এই কাজটি করে তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, এখন আর কোনও কিছুই অনতিক্রম্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সন্ত্রাসবাদীদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে সরব। মনে হচ্ছে, তাঁরা বুঝি ভুলে গিয়েছেন যে, অপারেশন সিঁদুর ভারতের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল না, তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাষ্ট্রের অভিযান। অবশ্য, তাঁদের কল্পনার হিন্দুরাষ্ট্রে কে শত্রু, সে বিষয়ে তাঁরা বিন্দুমাত্র সংশয় রাখেননি।
অপারেশন সিঁদুর ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতারও সাক্ষ্য বহন করে কি না, এই প্রশ্নটিও সংসদে অমীমাংসিতই থেকে গেল। গত কয়েক মাসে বারে বারেই প্রমাণ হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মহল ভারতের পাশে নেই— কিছু দেশ স্পষ্টতই পাকিস্তানের পক্ষে, আর কিছু দেশ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। বিভিন্ন দেশে সাংসদীয় প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রকল্পটিও শেষ অবধি ফলপ্রসূ হয়নি। শাসকরা এই ব্যর্থতা স্বীকার করবেন না, তা এক রকম স্বাভাবিক— কিন্তু, বিরোধী পক্ষও এই প্রশ্নটিতে তেমন জোর দিল না। রাহুল গান্ধী বলেছেন, অপারেশন সিঁদুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি রক্ষা। কথাটি ঠিক কি না, সে তর্কে না ঢুকেও বলা প্রয়োজন, দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত না করেও কী ভাবে সরকার পক্ষের গাফিলতিগুলি জনমানসে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে পথ খোঁজার নামই রাজনীতি। তাঁরা আড়াই মাসে সে কাজটি করতে পারলেন না। পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করার মতো ছেলেমানুষি কথায় না ঢুকে এই দিকগুলিতে মন দিলে তাঁরাও ভাল করতেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)