E-Paper

দুর্জয় ঘাঁটি

অধিকারী-মালবীয়ের বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন— এক, তাঁরা দেখাতে চান যে, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তরা একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ; এবং দুই, সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য প্রশাসন তাদের আড়াল করতে চান।

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:১৬

বিদ্বেষের বাস্তুতন্ত্র কী ভাবে কাজ করে, একটি দুঃখজনক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে কী ভাবে তা নিজের বিষাক্ত রাজনীতিকে অগ্রসর করতে চায়, দুর্গাপুর ধর্ষণ-কাণ্ডকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপি-র আইটি সেলের কর্তা অমিত মালবীয় তা হাতেকলমে দেখালেন। আরও এক বার। ঘটনার পরে পরেই শুভেন্দুবাবু সমাজমাধ্যমে চারটি নামের এক তালিকা দিলেন— ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তদের নামের তালিকা। নামগুলি দৃশ্যত মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের। সমাজমাধ্যমে তাঁর বার্তাটি পুনরায় শেয়ার করলেন অমিত মালবীয়। শুভেন্দুবাবু যেটুকু আবডাল রেখেছিলেন, শ্রীমালবীয় সেটুকুরও পরোয়া করেননি— চারটি নাম দিয়ে তিনি লিখলেন, এই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী নিগৃহীতার ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত। অতঃপর গৈরিক বাস্তুতন্ত্রে এই বার্তা বারে বারে শেয়ার হতে থাকল। ছড়াতে থাকল ঘৃণা। অধিকারী-মালবীয়ের বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন— এক, তাঁরা দেখাতে চান যে, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তরা একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ; এবং দুই, সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য প্রশাসন তাদের আড়াল করতে চান। সংখ্যালঘুদের অপরাধপ্রবণতা এবং বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির সংখ্যালঘু তোষণ সংক্রান্ত বয়ান হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বহুব্যবহৃত— অধিকারী-মালবীয়রা এই বয়ানের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে কৃতিত্ব দাবি করতে পারবেন না। তাঁরা একটি ধর্ষণের মর্মান্তিক ঘটনাকে ব্যবহার করছেন এই রাজনৈতিক বয়ানের পালে হাওয়া লাগানোর কাজে, এটুকুই। তাও এই প্রথম বার নয়। গত বছর আর জি কর-কাণ্ডের পরে সম্ভাব্য অপরাধী হিসাবে সমাজমাধ্যমে কিছু সংখ্যালঘু নাম ভাসিয়ে দেওয়ার খেলাও পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। ধর্মীয় মেরুকরণের খেলায় বিজেপি প্রশ্নাতীত রকম দড়। শুভেন্দু অধিকারীরা সেই খেলারই পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন।

তাঁরা যে কাজটি করছেন, প্রথমত তা মিথ্যাচার। তাঁদের মুখে এক বারও শোনা যায়নি পঞ্চম অভিযুক্তের কথা— যার নামে অনুমান যে, সে ধর্মে হিন্দু। শোনা যায়নি চার সংখ্যালঘু অভিযুক্তের এক জনের দিদির কথা, যিনি নিজে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ভাইয়ের গোপন আস্তানার কথা। কারণ, তিনি চাননি যে, ভাইয়ের ঘৃণ্য অপরাধ তাঁদের গোটা পরিবারকে কলঙ্কিত করুক। বিজেপির নেতারা স্বভাবতই এই কথাগুলি চেপে গিয়েছেন, কারণ এতে তাঁদের রাজনৈতিক বয়ানটির অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, এই ঘটনাগুলি যদি না-ই ঘটত? যদি অপরাধীর তালিকায় শুধু চারটি বা পাঁচটি সংখ্যালঘু নামই থাকত? যদি ওই দিদি আড়াল করতে চাইতেন অপরাধী ভাইকে? তা হলেই কি সত্য হয়ে যেত হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রের বয়ান? আঙুল তোলা যেত গোটা সম্প্রদায়ের দিকে? তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া যেত অপরাধী বলে?

প্রশ্নটির উত্তর এমনই স্পষ্ট, এমনই নির্বিকল্প যে, আলাদা করে সেই উত্তর উল্লেখ করা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাহুল্য বোধ হতে পারে। কিন্তু, পরিস্থিতিটি যে হেতু স্বাভাবিক নয়, তাই উত্তরটি জানানো প্রয়োজন: না, সেই অবস্থাতেও একটি গোটা সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তোলা যায় না। অপরাধীকে ‘অপরাধী’ হিসাবেই দেখা প্রয়োজন, তার ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা জাতের পরিচয়ে নয়। ধর্ষণে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি হওয়া বিধেয়, তাদের প্রতি কোনও রকম সহিষ্ণুতা দেখানো যাবে না। কিন্তু, তাদের ধর্মীয় পরিচিতির কারণে কোনও সম্প্রদায়কে অপরাধী সাব্যস্ত করা কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করতে পারেন না। সেটা ধর্মান্ধ রাজনীতির কাজ। অনুমান করা চলে যে, হিন্দুত্ববাদী নেতাদের আশা, এই পথে তাঁরা রাজ্যে ধর্মীয় ফাটলকে গভীরতর করতে পারবেন। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গ মৌলানা ইমদাদুল রশিদিকে চেনে। আসানসোলের এই ইমাম তাঁর পুত্র নিহত হওয়ার পরও কী ভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখার ডাক দিয়েছিলেন, এই রাজ্য জানে। বাংলার মাটি যে এখনও দুর্জয় ঘাঁটি, হিন্দুত্ববাদীরা সে কথা বুঝে নিক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Amit Malviya Durgapur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy