ভারতীয় রাষ্ট্র তার নাগরিককে ঠিক কী চোখে দেখে, বিভিন্ন উপলক্ষে তার প্রমাণ মেলে। ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়াটিই যেমন। কোনও বিশেষ ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার মানুষকে বাদ দেওয়ার চক্রান্তের যে অভিযোগ বিরোধীরা সমানেই করছেন, আপাতত সে প্রসঙ্গে ঢোকার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের চোখে যাঁরা তেমন ‘সন্দেহভাজন’ নন, তাঁদেরই বা কেমন ভাবে দেখে এসআইআর-এর প্রক্রিয়া? দু’টি উদাহরণ দেখা যেতে পারে। এক, ভিন জেলা থেকে যাঁরা খেতমজুরের কাজ করতে আসতেন, নিজেদের জেলায় এসআইআর-এর কাগজ জমা দিতে তাঁরা ঘরে ফিরেছেন। ফলে, খেতের কাজে শ্রমিক অমিল। বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যান, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই ফিরে আসছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক— কাজে না গেলে তাঁদের মজুরিও নেই। আর, মজুরি না থাকলে অনেকের হাঁড়িতে চালও থাকবে না, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ, গরিব মানুষের সামনে রাষ্ট্র দু’টি বিকল্প পেশ করেছিল— এক, অনির্দিষ্ট কালের জন্য রোজগার বন্ধ রেখে ভোটার তালিকায় নাম বজায় রাখা; এবং দুই, ভোটার তালিকার কথা ভুলে পেটের চিন্তা করা। এই এসআইআর-এ নাম না থাকলে পরবর্তী কালে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে কারও ধারণাই স্পষ্ট নয়— স্বল্পশিক্ষিত গরিব পরিযায়ী শ্রমিকের তো নয়ই। ফলে, তাঁরা কোন বিকল্পটি বাছবেন, অনুমান কঠিন নয়।
অন্য দিকে, বিহারের সংশোধিত ভোটার তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে, যত জন বাদ পড়েছেন, তার সিংহভাগই মহিলা। ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যেই বিয়ের পর মহিলারা পিতৃগৃহ ত্যাগ করেন। তাঁদের পদবি পাল্টে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে নামও। অনেকেরই বিয়ে হয় ভোটার তালিকায় নাম ওঠার বয়স হওয়ার আগেই। এসআইআর-এর প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র তাঁদের কাছে যে নথিপত্র চায়, অনেকের কাছেই তার থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। সরকারি চাকরির শংসাপত্র বস্তুটি এমনিতেও দেশের জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশের কাছে আছে, গ্রামাঞ্চলের মহিলারা সেই তালিকায় পড়েন না বললেই চলে। জমি-বাড়ির দলিলেও মেয়েদের নাম না থাকাই দস্তুর। স্কুল পাশের শংসাপত্রও বহু মহিলার নেই, কারণ তত অবধি পড়ার সুযোগ তাঁদের হয়নি। তালিকার অন্যান্য নথির ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে যে, বহু মহিলারই সে নথি থেকে গিয়েছে বাপের বাড়িতে— ক্ষেত্রবিশেষে তার ঠাঁই হয়েছে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে। ফলে, তাঁরা বাদ পড়েছেন ভোটার তালিকা থেকে। সেই বহিষ্কারের কোন মূল্য ভবিষ্যতে চোকাতে হবে, সে ধারণা তাঁদের আছে বলে সংশয় হয় না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এমন পরিস্থিতিতে কী বা করার থাকতে পারে রাষ্ট্রের? ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজটিও তো করতে হবে। সেই সংশোধনের প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে প্রশ্ন অন্যত্র। এখানে সংশয় শুধু একটিই— যথেষ্ট নির্মম না হলে, ব্যক্তির অপারগতাকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন করে দিতে না পারলে কি রাষ্ট্রের দাপট প্রতিষ্ঠিত হয় না? মহিলাদের পরিস্থিতির কথাটি রাষ্ট্রের অজানা নয়; পরিযায়ী শ্রমিকদের বাধ্যবাধকতাও একই রকম জানা। আজকের ডিজিটাল যুগে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক জায়গা থেকেই তালিকায় নাম তুলতে হবে কেন? একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে এ কাজ করা যেত কি না, নির্বাচন কমিশন কি আদৌ তা যাচাই করে দেখেছে? অথবা, মেয়েদের বিয়ের নিবন্ধীকরণের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের ভোটার তালিকার নথিও শ্বশুর বাড়ির এলাকায় নিয়ে যাওয়ার কোনও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার কথা কি ভেবেছে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর নেতিবাচক বলেই অনুমান করা চলে। তার কারণ হল, যে কোনও অর্থেই প্রান্তিক, এমন মানুষের কথা ভাবার অভ্যাসটি রাষ্ট্র বহু দিন আগেই ত্যাগ করেছে। ফলে, রাষ্ট্রের নীতিতে হয়রান হওয়াই তাঁদের ভবিতব্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)