বাজার থেকে টাকা তোলার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কর্পোরেট বন্ড বা ঋণপত্র ছেড়েই থাকে, অন্য লগ্নিকারী সংস্থাও তাতে লগ্নি করে। তা নিয়ে সচরাচর তেমন হইচই হয় না। আদানি গোষ্ঠীর ঋণপত্রে ভারতীয় জীবন বিমা নিগমের লগ্নি নিয়ে হল। একটি আমেরিকান সংবাদপত্র তদন্তমূলক প্রতিবেদনে দাবি করল যে, অর্থ মন্ত্রক থেকে নির্দেশ পেয়েই ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বৃহত্তর বিমা নিগম এমন একটি সংস্থায় ৫,০০০ কোটি টাকা লগ্নি করল, যেখানে টাকা ঢালতে বিশ্বের তাবড় ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য লগ্নিকারী সংস্থা দ্বিধাগ্রস্ত— যে সংস্থার বিরুদ্ধে আমেরিকা-সহ বিশ্বের একাধিক দেশে সরকারি স্তরে আপত্তি রয়েছে, বা তদন্ত হচ্ছে। বিমা নিগমের তরফ থেকে প্রতিবেদনটিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গোড়াতে কয়েকটি কথা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এলআইসি জানিয়েছে, প্রতি বছর তারা যত টাকা লগ্নি করে, এই বিনিয়োগ তার এক শতাংশেরও কম। দ্বিতীয়ত, কর্পোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে কোনও একটি সংস্থাকে বিশেষ ভাবে সব বন্ড কিনতে অনুরোধ করার ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। অতএব, শুধু এটুকু কারণেই হইচই করা চলে না।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের উত্তরে আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদীর জাতীয় নেতৃত্বে উত্থানের আগেই তাদের গোষ্ঠীর আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে। কথাটির মধ্যে তিলমাত্র মিথ্যা নেই। হিসাব বলছে, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আদানি গোষ্ঠীর মূল্য ২০০০ সালে ছিল ৩,৩০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগের বছর, সেই গোষ্ঠীর মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৭,০০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, বছরে গড়ে ২২.৬৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই বিপুল বৃদ্ধির নজির দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। খেয়াল করা প্রয়োজন, এই সময়কালেই ঘটে গিয়েছে ২০০৭-০৮’এর অর্থনৈতিক সঙ্কট। এবং, আরও খেয়াল করা প্রয়োজন যে, গুজরাত-কেন্দ্রিক এই সংস্থার সেই প্রবল বৃদ্ধির আমলে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজার প্রয়োজন নেই, শুধু ‘ক্রোনোলজি’টুকু বুঝলেই যথেষ্ট। এ কথাও মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে, ২০০২-এর ঘটনার পরের বছর যখন ভাইব্র্যান্ট গুজরাত সম্মেলনের সূচনা হয়, তখন প্রারম্ভিক বছরে সবচেয়ে বড় লগ্নি— ১৫,০০০ কোটি টাকার— প্রস্তাবটিও দিয়েছিলেন গৌতম আদানি। মোদীর রাজনৈতিক উত্থান এবং আদানির বাণিজ্যিক উত্থানের রেখচিত্র দু’টির মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মিল লক্ষ করতে পারেন কেউ।
২০১৪ সালের পরের এগারো বছরেও আদানি গোষ্ঠীর সমৃদ্ধি অব্যাহত— খুব রক্ষণশীল অনুমানও বলছে, এই দশকাধিক কালে গোষ্ঠীর বার্ষিক আর্থিক বৃদ্ধির হার থেকেছে ১৫ শতাংশের উপরে। এই সময়কালটিতে কোভিড অতিমারি ঘটেছে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর সাফল্যে তার প্রভাব পড়েনি। দুর্জনে বলবে, সাঙাততন্ত্রের সেরা ফসলটি এই গোষ্ঠীর ঘরেই উঠেছে— কিন্তু, এও তো সম্ভব, হয়তো এই সংস্থার পরিচালনার গুণগত মানই এ-হেন সাফল্যের কারণ? দুর্জনে প্রশ্ন করবে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে গৌতম আদানি যে দেশেই গিয়েছেন, সেখানেই তাঁর সংস্থা বাণিজ্যিক বরাত পেয়েছে, এটাও কি সমাপতন? দুর্জনকে মনে করিয়ে দেওয়া বিধেয় যে, যত ক্ষণ না কোনও অকাট্য প্রমাণ মেলে, তত ক্ষণ দুই শীর্ষ স্তরের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে এমন কোনও অভিযোগ আনা চলে না, এই যুক্তিতে সাম্প্রতিক ভারতের দস্তুর হল— হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পর রাষ্ট্রযন্ত্র কোনও ব্যক্তিবিশেষের সমর্থনে মাঠে নেমে পড়লেও অভিযোগ চলে না, দেশের পরিকাঠামো বরাতের সিংহভাগ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে গেলেও তা চলে না। আপাতত দুর্জনরা আত্মসম্বরণ করুন, বিদেশি সংবাদপত্রটি যত ক্ষণ না সব নথি জনসমক্ষে এনে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করছে, তত ক্ষণ এই ভারতে রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠানোও চলে না!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)