E-Paper

সোনালিদের ‘দেশ’

প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চ প্রশ্ন তুলল— কেন সোনালির বক্তব্য না শুনেই তাঁকে সরকার এ ভাবে সীমান্ত পার করে দিয়েছে। সরকারের প্রতি তাঁদের বার্তা: “নিরপেক্ষ ভাবে আপনারা আপনাদের কাজ করুন।”

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৫

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দেশে ফিরতে পারলেন বীরভূমের সোনালি বিবি ও তাঁর পুত্র। জুন মাসে দিল্লি থেকে অন্তঃসত্ত্বা সোনালি-সহ ছয় জনকে বলপূর্বক পশ্চিমবঙ্গেনিয়ে এসে তাঁদের জোর করে সীমান্ত পার বা ‘পুশব্যাক’ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ঘটনাটির অমানবিকতা অবিস্মরণীয়। সরকারি সিলমোহর-সহ এই ভাবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার উপর জবরদস্তি ও বিতাড়ন— ভারতের সাম্প্রতিক কালিমালিপ্ত মুকুটটিতে নিশ্চয়ই আর একটি ‘পালক’। সোনালি খাতুন, সুইটি খাতুন ও তাঁদের নাবালক সন্তান-সহ যাঁদের ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছিল, তাঁদের প্রত্যেকের মানবাধিকার হননের দায় মুদ্রিত হয়ে রইল ভারতীয় রাষ্ট্রের রেকর্ডে। প্রসঙ্গত, শব্দটি এখানে মানবাধিকার— নাগরিক অধিকার নয়। নাগরিক কি না, সেই প্রশ্ন পাশে সরিয়ে রেখেও বলা জরুরি, সাধারণ মানবিক অধিকার রক্ষার আদর্শটিও একেবারে ফেলনা নয়। বরং অতীব গুরুতর ও মৌলিক এই আদর্শেরই ভিত্তিতে আধুনিকমনস্ক পৃথিবীতে যুদ্ধবন্দি কিংবা অপরাধীর প্রতিও যদৃচ্ছ হিংসা দেখানো যায় না। সেই আদর্শ এখনকার ভারতে কতখানি পদদলিত, সোনালি বিবি তার প্রমাণ। এ দেশে এখন রাষ্ট্রিক আটঘাট বেঁধে অপরাধ ব্যতিরেকেই যে কোনও মানুষের উপর তীব্র অত্যাচার চালানো যায়। নতুবা, পুশব্যাকের পর প্রশ্ন উঠলে আদালত অবধি যাওয়ার দরকার হত না, সরকারই সোনালি-সমস্যার সমাধান করতে পারত, তাঁকে ফিরিয়ে এনে, তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে। লক্ষণীয়, এই বছর ২৬ নভেম্বর দেশের সংবিধান দিবস উদ্‌যাপনের আগের দিনই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ধ্বনিত হল সোনালি বিবি সংক্রান্ত মামলায় সু্প্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা। প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চ প্রশ্ন তুলল— কেন সোনালির বক্তব্য না শুনেই তাঁকে সরকার এ ভাবে সীমান্ত পার করে দিয়েছে। সরকারের প্রতি তাঁদের বার্তা: “নিরপেক্ষ ভাবে আপনারা আপনাদের কাজ করুন।” এর পরও সংবিধান নিয়ে শ্লাঘাময় সরকারি উদ্‌যাপন দেখে একটিই কথা বলার থাকে: লজ্জাহীন।

জোর করে দেশ থেকে বার করে দেওয়ার আগে সোনালিদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সরকারের তরফে তাঁদের নাগরিকত্ব সন্ধানের চেষ্টাও করা হয়নি। বাস্তবিক, বিতাড়নের পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত দাবি করে এসেছে যে সোনালি এবং বাকিরা বাংলাদেশি, বেআইনি অভিবাসী হিসাবে ভারতে বসবাস করছিলেন। এই দাবি শোনার পর থেকে শাসক দলের প্রশ্নহীন সমর্থক ব্যতীত সকল নাগরিকেরই মনে স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন জাগ্রত হয়। সৌভাগ্য যে, মাননীয় বিচারপতিরা সেই প্রশ্নগুলিই সামনে এনেছেন। সোনালির বাবার নথি পাওয়া গেলেও সোনালির সঙ্গে বাবার সম্পর্ক প্রমাণের উপযুক্ত নথির অভাব কি একটি গোড়ার সমস্যা নয়? তা কি বুঝিয়ে দেয় না, ভারতের গ্রামীণ জনসমাজে, এমনকি শহর-মফস্‌সলেও, এক বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্মের শংসাপত্র কিংবা অন্য কোনও উপায়ে পিতৃমাতৃ সম্পর্ক প্রমাণের উপায় নেই? তা হলে কি তাঁদের সকলকেই বাংলাদেশি তথা অনুপ্রবেশকারী বলা হবে? না কি তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাংলাভাষী মুসলমান, ভাষা ও ধর্ম বেছে বেছে কেবল তাঁদেরই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলা হবে?

সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: কেউ যদি বলেন ভারতে জন্ম নিয়েছেন, এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছেন, তবে তাঁর বৈধ নাগরিকত্বের অধিকার রয়েছে। আসল কথা, অন্ধ নথিভিত্তিক যাচাই প্রক্রিয়া ভারতের মতো দেশে অচল, আর তাই এসআইআর ও তার বকলমে নাগরিকত্বের পরীক্ষা এত বিপজ্জনক ও ভ্রান্ত। ইতিমধ্যে ভারতে ও বাংলাদেশে, সীমান্তের দুই পারেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত হয়ে, ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে, বাংলাদেশে কারাবদ্ধ হয়ে সোনালি বিবি দেখিয়ে দিলেন, রাষ্ট্রের মানবিকতাবর্জিত নীতির জাঁতাকলে কতখানি পিষ্ট, ধ্বস্ত হতে পারে মানুষের জীবন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Citizen Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy