বিশ্ব ভূরাজনীতির একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য: কোনও স্থায়ী মিত্র বা প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই, রয়েছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ। সাম্প্রতিক কালে চিনের ক্ষেত্রে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানে এই নীতির অনুরণন স্পষ্ট। বস্তুত, দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন (এপিইসি) সম্মেলনের মাঝে পার্শ্ববৈঠকে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতা সতর্কতার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা করলেন। বৈঠকের পরে, সয়াবিন-সহ আমেরিকান কৃষি পণ্যের সীমিত ক্রয় চিন পুনরায় শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্য দিকে, ওয়াশিংটন-ও বিবেচনাধীন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে। আলোচনায় বিরল মৃত্তিকার রফতানি নিয়ন্ত্রণ এবং ফেন্টানাইল ড্রাগ পাচার রোধে সহযোগিতার বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও চিনের কোন পণ্যে কতটা শুল্ক কমতে চলেছে, দুই দেশের পরস্পরের পণ্যে কার্যকর শুল্কের হার কী হবে, সে বিষয় খোলসা করেননি ট্রাম্প। ফলে বৈঠকের চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
বহু কাল ধরেই আমেরিকা এবং চিন অর্থনৈতিক এবং আদর্শগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। গত কয়েক দশক ধরে তাদের বাণিজ্য যুদ্ধ, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা এবং কৌশলগত পদক্ষেপ এই ধারণাকে পোক্ত করেছে যে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাঠামোগত এবং স্থায়ী। তবে সময়ের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার উভয়ের ক্ষেত্রেই সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি করেছে। লক্ষণীয়, বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি, যা বিশ্ব বাজারে স্থিতিশীলতার দাবি করে। অন্য দিকে, বেজিংয়ের জন্য, বৈঠকটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ বটে। এক দিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির শম্বুকগতি এবং অন্য দিকে বেকারত্ব ও ঋণ বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক তাঁকে সেই সুযোগটিই এনে দিল। বেজিং এখন এই নতুন ভারসাম্যের সীমা পরীক্ষা করতে পারে— তা সে প্রতিবেশীদের উপর চাপের মাধ্যমে হোক বা এশিয়া জুড়ে নতুন কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই হোক।
এ দিকে ট্রাম্প-শি বৈঠক ইতিমধ্যেই এশিয়া জুড়ে আঞ্চলিক সমীকরণে বহু অদল-বদল ঘটাচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রেও। ওয়াশিংটন এবং বেজিং— উভয়ের সঙ্গে দিল্লির সমীকরণ কী ভাবে বিকশিত হবে, তা দেখার। এর আগেও ভারতের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে উভয় দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক দিয়ে, যা কিছু ক্ষেত্রে দিল্লিকে কৌশলগত বিচ্ছিন্নতার পথেও ঠেলে দিয়েছে। দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি উদ্বেগ বাড়িয়েছে দিল্লির, বিশেষত ভূরাজনৈতিক পরিসরে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কায়। তবে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিল্লিরও নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। বরং, ক্রমপরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক মঞ্চে সক্রিয় খেলোয়াড় হিসেবেই যোগ দিতে হবে দিল্লিকে। ভোলা উচিত নয়, সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের মাঝেও দুই রাষ্ট্রের কাঠামোগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল। ফলে সতর্ক পদক্ষেপ করতে হবে যাতে অতিনির্ভরতার ঝুঁকি এড়ানো যায়। এশিয়ার সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজের কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি-সহ বিদেশনীতির সতর্ক ক্রমাঙ্কন তাই জরুরি হয়ে উঠেছে দিল্লির কাছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)