বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মীদের একাংশ এখনও আন্দোলনে অনড়। ফাইল চিত্র।
সরকারি অফিসে নাকি কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে চায় রাজ্য। সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্যসচিবের পক্ষ থেকে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি যে নির্দেশগুলি দেওয়া হল, তার সবই নাকি সেই কর্মসংস্কৃতি পুনরুদ্ধার বা নির্মাণের সুমহান উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে। যেমন, সময়ানুবর্তিতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে; জানানো হয়েছে যে, অফিসে কাজের সময়ে কোনও আধিকারিক বা কর্মচারী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া অফিস থেকে বেরোতে পারবেন না। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশটি এসেছে ‘টিফিন টাইম’কে ঘিরে। বলা হয়েছে, দুপুর দেড়টা থেকে দুটো পর্যন্ত সময়কালটিকে শুধুমাত্র কর্মচারীদের টিফিন খাওয়ার বিরতি হিসাবেই গণ্য করতে হবে, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে এই সময়কে কাজে লাগানো যাবে না। অন্যথায়, তা অফিসে ‘অনুপস্থিতি’ বলে বিবেচিত হবে এবং নিয়মানুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে। পরিকল্পনাটি শুনলে মনে হয়, সরকার বাহাদুর বুঝি সাক্ষাৎ মেজদা— তাঁর সামনে সারি সারি টিকিট, কোনওটিতে লেখা ‘বাইরে’, কোনওটিতে ‘জল খাওয়া’, কোনওটিতে ‘থুতু ফেলা’— মেজদা গম্ভীর মুখে টিকিটে সময় লিখছেন, আর খাতায় হিসাব রাখছেন।
তবে, এই বিজ্ঞপ্তিটি নিছক কর্তালি ফলানোর জন্য নয়। বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মীদের একাংশ এখনও আন্দোলনে অনড়। সুতরাং, কর্মসংস্কৃতির অছিলায় নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে সরকার প্রকারান্তরে কর্মচারীদের আন্দোলনের অধিকারটিকেই হরণ করতে চাইছে বলে অনুমান করা চলে। ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী এখন জেলে, কিন্তু তাঁর ঘোষিত আদর্শটি এখনও সরকারের অনুপ্রেরণা বলে বোধ হয়— মাইনে যখন দিচ্ছি, তখন নিয়ন্ত্রণও করব। ভূতপূর্ব মন্ত্রিমশাই স্কুল-কলেজে ছড়ি ঘোরাতে চাইতেন, রাজ্য সরকার মাইনে দেওয়ার অধিকারে কর্মীদের ব্যক্তিসত্তার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোনও অবকাশ রাখতে চায় না। ভারতীয় সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত। কোনও সংগঠন, গোষ্ঠী, বা ব্যক্তিবিশেষ বিনা বাধায় সরকারের বা রাষ্ট্রের যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন, নিজ মত প্রকাশ করতে পারেন। ছলে-বলে সেই অধিকারটি হরণ করতে চাওয়া ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শনের পরিপন্থী।
প্রশ্ন হল, সরকারি কর্মচারীদের এই আন্দোলন ঠেকাতে রাজ্য সরকার এমন মরিয়া কেন? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি, এবং সরকার পোষিত প্রতিষ্ঠানে কর্মীর মোট সংখ্যা যতই হোক না কেন, রাজ্যের মোট ভোটারসংখ্যার অনুপাতে তা নগণ্য। ফলে, এই আন্দোলন ভোটবাক্সে সরাসরি যে প্রভাব ফেলবে, তা তীব্র নয়। হয়তো শাসক দলের আশঙ্কা, সরকারি কর্মীদের এই আন্দোলন রাজ্যে বৃহত্তর ক্ষোভগুলিকে উস্কে দেবে। রাজনৈতিক ভাবে তা বিপজ্জনক, কিন্তু প্রশাসনকে ব্যবহার করে তো সেই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা চলে না। সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতার দাবিটি আদৌ ন্যায্য কি না, গণপরিসরে সেই রাজনৈতিক প্রশ্নটি উত্থাপন করার দায়িত্ব দলের, সরকারের নয়, প্রশাসনের তো নয়ই। দলের রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির অভাবকে প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের জোরে ঢাকতে চাওয়ার প্রবণতাটি মারাত্মক— প্রশাসনের পক্ষেও, দলের পক্ষেও। মুখ্যমন্ত্রী সেই পথে বিপজ্জনক গতিতে হাঁটছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy