গাজ়ায় প্রত্যহ গভীরতর— মানবিক সঙ্কট। গত কুড়ি মাসে হাজার হাজার শিশু-সহ এই ভয়াবহ যুদ্ধের বলি হয়েছে ৫৫,০০০-এরও বেশি মানুষ। সমীক্ষা বলছে, এই সময়ে গাজ়ায় অন্তত ১,০০,০০০ টন বোমা ফেলেছে ইজ়রায়েল। যুদ্ধের কৌশল হিসাবে অনাহার পরিস্থিতির সৃষ্টি ও মানবিক সাহায্য পৌঁছতে না দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। গোটা বিশ্ব আজ এই মানবিক সঙ্কট প্রশমনের পথ খুঁজছে। একটি খসড়া প্রস্তাব সম্প্রতি গৃহীত হল ১৯৩ সদস্যের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে ইজ়রায়েল এবং হামাস— দুই তরফের কাছেই তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে হামাস এবং অন্যান্য গোষ্ঠী দ্বারা আটক বন্দিদের অবিলম্বে মর্যাদাপূর্ণ ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও পুনরায় তোলা হল। যেটা অতি গুরুত্বপূর্ণ— রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৯টি ভোট পড়লেও, ১৯টি দেশ ভোট থেকে বিরত থাকে— এবং ভারত সেই ১৯টি রাষ্ট্রের অন্যতম।
ভারত সরকারের যুক্তি: অতীতের ভোটদানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে, যে-হেতু দিল্লির বিশ্বাস, সংলাপ এবং কূটনীতি ছাড়া এই সংঘাত সমাধানের অন্য কোনও পথ নেই। বরং দুই পক্ষকে কাছাকাছি আনতে একটি যৌথ প্রচেষ্টা চালানো উচিত। দিল্লির দাবি, ইজ়রায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যায় তারা বহু কাল ধরেই দ্বিরাষ্ট্র নীতির পক্ষে সওয়াল করে আসছে, যার ফলে একটি সার্বভৌম, স্বাধীন ও কার্যকর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের নির্মাণ হবে, যারা ইজ়রায়েল-এর সঙ্গে নিরাপদ ও স্বীকৃত সীমানার মধ্যে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও ভারতের রাষ্ট্রপুঞ্জের ভোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা আকস্মিক নয়। ইজ়রায়েল-এর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। পূর্বে, দিল্লি বরাবরই প্যালেস্টাইনের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করে এসেছে। ভারত ছিল অ-আরব রাষ্ট্রগুলির অন্যতম, যারা ১৯৭৪ সালে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন’ (পিএলও)-কে এবং ১৯৮৮-তে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকেও স্বীকৃতি দেয়। সেই সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের বেশির ভাগ প্যালেস্টাইন-পন্থী প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় দিল্লি। এ বারের সংঘর্ষে কিন্তু স্পষ্ট ব্যতিক্রম: উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এক বারও সরাসরি নিন্দা করেনি দিল্লি। বাস্তবিক, গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভোটদানে বিরত থাকাই বুঝিয়ে দেয় প্যালেস্টাইন নীতিতে লক্ষণীয় বদল এনেছে মোদী সরকার। তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, এমন সংঘাতে পক্ষপাত দিল্লি এড়িয়ে চলতে চায়। তবে, দিল্লির কূটনৈতিক বিবেচনার মধ্যে গাজ়ার অভূতপূর্ব মানবিক সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া আরও কিছুটা প্রতিফলিত হতে পারত কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নানা কারণেই এখন ইজ়রায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক দিল্লির— সাইবার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির পাশাপাশি প্রতিরক্ষাতেও। সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন পদক্ষেপকে অনেকাংশে ইজ়রায়েল-প্রভাবিত বলেও মনে করেন অনেকে। অনুমান, অদূর ভবিষ্যতেও প্যালেস্টাইন প্রশ্নে দিল্লি এই নতুন অভিমুখটিই বজায় রাখবে। তবে, প্যালেস্টাইনকে সমর্থন, এবং ইজ়রায়েলি সংঘর্ষ বৃদ্ধির বিরোধিতা— দু’টি এক বিষয় কি না, এর উত্তরও খুঁজতে হবে দিল্লিকে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)