চাষিরা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছেন নীরব হতাশায়।
ঢাকায় এক যুব সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মুজফ্ফর আহমেদ বলেছিলেন, “আমাদের কৃষকগণ, শ্রমিকগণ, এক কথায় জনগণ অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রনীতিকভাবে পরিপূর্ণ মুক্তিলাভ না করিলে ভারতবর্ষ কখনো স্বাধীন হইবে না, ইংরেজ চলিয়া গেলেও না।” এই মতটি নানা মতের নেতাদের আলোচনায় ঘুরে-ফিরে এসেছে। উচ্চারিত হয়েছে এই উদ্বেগ যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, প্রশাসনের স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতার অবয়ব মাত্র। তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই জনসমাজে সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদ্যাপনের রাষ্ট্র-পরিকল্পিত নানা আয়োজনের উত্তেজনা-উদ্দীপনার মধ্যে বার বার বেসুরো বেজে উঠবে একটি প্রশ্ন— দেশের চাষিরা কই, মজুরেরাই বা কোথায়? এ বছর প্রকৃতি বিরূপ, রবি মরসুমে গমের উৎপাদন কমেছে। রেশন ব্যবস্থার জন্য সরকার গত বছর যত গম কিনেছিল, এ বছর কিনেছে তার অর্ধেকেরও কম। গমের অভাব পূরণ করতে বাজার থেকে চাল কিনছে সরকার, তাই দাম বেড়েছে চালের। তার উপর খরিফ মরসুমে বৃষ্টি এতই কৃপণ যে, ভারতে ধান-চাষের জমি কমেছে অন্তত তেরো শতাংশ। উদ্বেগের দোলাচল থেকে চাষিরা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছেন নীরব হতাশায়। আশঙ্কা বাড়ছে শহর-মফস্সলের শ্রমজীবী মানুষেরও— চালের দাম কি নাগালের বাইরে চলে যাবে? এ দেশ এখনও অধিকাংশ চাষের খেতে জল পৌঁছতে পারেনি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সত্ত্বেও চাষিকে উন্নত, সুরক্ষিত চাষের দিশা দেখাতে পারেনি। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা এখনও যে দেশে ফসলের ভাগ্য নির্ধারণ করে, সে দেশের চাষির হৃদয় থেকে কি উত্থিত হতে পারে ভাগ্যবিধাতার জয়গান?
ইংরেজ শাসনে দেশের বড় মঙ্গল হয়েছে, এই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে চাষিদের অবস্থার দিকে নির্দেশ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোক্ষম প্রশ্নটি করেছিলেন, “বল দেখি চসমা— নাকে বাবু! ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?” উনিশ শতকে দেশের ‘মঙ্গল’-এর ধারণার মতো, একবিংশে এসে ‘উন্নয়ন’-এর ধারণাকেও সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। স্বাধীন দেশ প্রথম কয়েক দশকে যে অগ্রগতির ইচ্ছা দেখিয়েছিল, ক্রমশই তার বেগ শ্লথ হয়েছে। উন্নয়নের দিশা স্থির থাকেনি। জলবায়ু পরিবর্তনে দরিদ্রের জীবন-জীবিকায় অভূতপূর্ব সঙ্কটের সৃষ্টি হলে দেশের সরকার উদাসীন থেকেছে। সেচ-সার-কীটনাশকের সাবেক নিদান জমিকে অনুর্বর করে, ভূগর্ভকে জলহীন করে চাষিকে বিপন্ন করলেও নীতিতে পরিবর্তন আসেনি। মজুরের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু প্রাণসুরক্ষার প্রযুক্তি আসেনি মজুরের হাতে, গত তিন বছরে দেড়শোরও বেশি মজুর নিকাশি ড্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। নির্মাণক্ষেত্রে আজও দিনে গড়ে ত্রিশ জনের বেশি শ্রমিক নিহত হন নানা দুর্ঘটনায়। মূল্যবৃদ্ধির বহু পিছনে মজুরির হারে বৃদ্ধি, তাঁত বা বিড়ির মতো শিল্পে মজুরি কমেছে। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা আন্দোলন যত বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, তার প্রায় প্রতিটির অন্তঃস্থলে জায়গা নিয়েছিল সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবি, সাধারণ মানুষের জীবনের ক্লেশ কমানোর প্রয়াস। আজও কিন্তু দেশের ‘অগ্রগতি’-র যে কোনও দাবিরই কষ্টিপাথর হতে হবে কৃষক-শ্রমিকের আয় ও মর্যাদার সেই হিসাবকেই। সে হিসাব কষলেই বোঝা যাবে, পরীক্ষায় ভারতের ফল গৌরবময় কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy