বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রহর তবে এসেই গেল। এ বারে বিহার নির্বাচন যতখানি জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, নিশ্চিত ভাবেই তা ঐতিহাসিক। সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির জটিল সমস্যাসমূহ আরও এক বার সেখানে প্রকট হল, সঙ্গে যুক্ত হল একেবারে নতুন মাপের ও নতুন মানের একটি সঙ্কট— এসআইআর। এই সম্পাদকীয় কলমে এ বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই হয়েছে। কেবল ভোটের প্রাক্কালে আরও এক বার স্মরণ করা ভাল যে, বাতিল ভোটারের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার স্বাভাবিক অনুপাত ছাপিয়ে মুসলমান ও প্রান্তিক পরিচিতির মানুষ, এবং নারীদের নাম থাকা বিরাট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মুসলমান নাম বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার, এবং তার পিছু পিছু বিহারের রাজ্য সরকার যদিও অনুপ্রবেশ তত্ত্ব পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করছে, সংশয়ের অবকাশ ঘোচে না। কেননা, যে সব জেলা থেকে বেশি নাম বাদ গিয়েছে, সেগুলি ঐতিহ্যানুসারেই সংখ্যালঘু-প্রধান অঞ্চল। মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্নটি আরও বড়। প্রয়োজনীয় নথিপত্র যদি মহিলারা জোগাড় না করতে পেরে থাকেন, তা হলে তাঁদের যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে কি না, যথাযোগ্য সহায়তা প্রদান করা গিয়েছে কি না, এ সব প্রশ্ন ওঠেই। যে দ্রুততার সঙ্গে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা হল, তাতে এক জনও ভারতীয়ের নাম (নারী ও মুসলমানরাও তার মধ্যে পড়েন বইকি) ভুল ভাবে ভোটারতালিকার বাইরে পড়লে এই বিরাট সংস্কারযজ্ঞ সাধনের যুক্তি ও নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন উঠেছেও। রাহুল গান্ধী ও তেজস্বী যাদবদের নেতৃত্বে বিরোধী শিবির বারংবার দাবি তুলেছেন, বিহারে এসআইআর-এ রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের স্পষ্ট আভাস। ভারতীয় গণতন্ত্র বিষয়েই মৌলিক সংশয় তৈরি করল বিহারে এসআইআর প্রথম পর্ব, এবং প্রাক্-নির্বাচন কালের বিহার বড় মাপের অস্তিত্বমূলক প্রশ্নের সামনে ঠেলে দিল পশ্চিমবঙ্গ-সহ বারোটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআর দ্বিতীয় পর্বকে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থীমুখ স্থির করা নিয়ে শাসক এনডিএ এবং বিরোধী মহাগঠবন্ধন, দুই জোটেই দেখা গেল এ বার বিবিধ জটিলতা, এবং সেই কারণে অত্যধিক বিলম্ব। শেষ পর্যন্ত নীতীশ কুমার ও তেজস্বী যাদবের প্রত্যাশিত নাম দু’টিই চূড়ান্ত হল, তবে সম্ভাব্য দলমুখ নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে এত দেরির পিছনে দুই শিবির-অভ্যন্তরেই বিপুল স্বার্থরেষারেষি আছে, তা বোঝাই যায়। এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিন্তু কোনও আদর্শ বা রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে নয়, প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ পছন্দ-অপছন্দকে কেন্দ্র করে। অথচ রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ‘ন্যায় সংবাদ’ এ বার মাটির কাছাকাছি সমস্যা-সঙ্কটের আলোচনার নতুন আশা তৈরি করেছিল, রাহুল ও তেজস্বীকে কেন্দ্র করে এ বার জন-আন্দোলনের কিছু ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। এমনকি প্রশান্ত কিশোরের নতুন জন সুরাজ পার্টিও দীর্ঘমেয়াদি আর্থ-সামাজিক সমস্যার কথা শুরু করেছিল। কিন্তু ক্রমশই বিহারের ভোট চালিত হতে শুরু করল সেই পুরনো আসনবণ্টন, প্রার্থী মনোনয়ন ইত্যাদি নিয়ে তীব্র আন্তঃশিবির সংঘাতের পথে। একই এনডিএ শিবিরের মধ্যে লোক জনশক্তি পার্টি বা এলজেপি, ও নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) ভোট-পরবর্তী স্বার্থের সংঘাত। ও-দিকে আরজেডির একাংশে এবং কংগ্রেসের মধ্যে দেখা গেল তীব্র তেজস্বী-বিরোধিতা। ইতিমধ্যে প্রায় নজিরবিহীন ভাবে নিজের দলের প্রার্থী আফজ়ল খানের বিরুদ্ধেই প্রচার করলেন তেজস্বী স্বয়ং। ‘মোদী কি গ্যারান্টি’র অনুকরণে তেজস্বীকে সামনে রেখে মহাগঠবন্ধনের ভোট ইস্তাহার ‘বিহার কা তেজস্বী প্রণ’-এর অত্যন্ত বড় মাপের সব প্রতিশ্রুতি সেগুলি পূরণের পরিকল্পনা নিয়ে সংশয় তৈরি করে। সব মিলিয়ে আশঙ্কা, এক দিকে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত সংঘাত ও অন্য দিকে ধর্ম ও জাতের সত্তাপরিচিতির দড়ি-টানাটানি বিহারে বৃহত্তর সমাজ-অর্থনীতির বিষয়গুলিকে হয়তো গৌণ করে দিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)