E-Paper

গান্ধী, আজ

গান্ধীর শিল্পায়ন-বিরোধিতার মধ্যে বৃহৎ শিল্পের যে ‘ক্রিটিক’— যে সমালোচনাটি— রয়েছে, তার গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:১৭

যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে, আজকের ভারতে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর কি আদৌ কোনও তাৎপর্য আছে, ভারত নামক রাষ্ট্রের বর্তমান চলন দেখলে সে প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দেওয়া ভিন্ন উপায় নেই। হরেক মূল্যের টাকার নোটে তাঁর ছবি আছে; দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান প্রকল্পে তাঁর নাম আছে; স্বচ্ছতা অভিযানের প্রতীকেও তাঁর চশমাটি আছে— কিন্তু, তিনি যেন কোথাও নেই। গান্ধী যে দেশটি কল্পনা করেছিলেন, আজকের ভারত যেন সর্বশক্তিতে তার বিপ্রতীপ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, সেটাই কি সবচেয়ে বড় কারণ নয় গান্ধীকে তাৎপর্যপূর্ণ জ্ঞান করার— আজকের ভারত যা হয়ে উঠেছে, প্রতিটি ধাপে তার কঠোরতম সমালোচনাটি পাওয়া যাবে গান্ধীর দর্শনে। ঘটনা হল যে, শুধু আজ নয়, তাঁর জীবদ্দশাতেই অন্তত কিছু কিছু প্রশ্নে ভারত মনস্থ করেছিল তাঁর মতের বিপরীত অভিমুখে হাঁটতে। অথবা, দৌড়তে। যেমন, তাঁর প্রিয়তম দুই শিষ্য জওহরলাল নেহরু এবং বল্লভভাই পটেল; অথবা, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তাঁর প্রতি সবচেয়ে বড় অমান্যতার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া সুভাষচন্দ্র বসু— কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী পরিসরের মধ্যে বহু মতান্তর সত্ত্বেও তাঁরা এই বিষয়ে এক মত ছিলেন যে, স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে দ্রুত শিল্পায়ন প্রয়োজন। সেই প্রক্রিয়ার চরিত্র কী হবে, মতভেদ ছিল সে প্রশ্নে— কিন্তু, দ্রুত শিল্পায়নের গুরুত্ব বিষয়ে তাঁরা একমত ছিলেন। এবং, সেই মতামতের ঠিক উল্টো দিকে ছিলেন গান্ধী। বৃহৎ শিল্পের প্রতি তাঁর বিরোধিতা এক-এক সময় কার্যত অন্ধবিশ্বাসের স্তরে পৌঁছে যেত, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই— তাঁর গ্রাম স্বরাজের মডেলটিও যে আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী নয়, সে কথাও একই রকম অনস্বীকার্য। কিন্তু, গান্ধীর শিল্পায়ন-বিরোধিতার মধ্যে বৃহৎ শিল্পের যে ‘ক্রিটিক’— যে সমালোচনাটি— রয়েছে, তার গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

১৯৩৯ সালে যখন জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি-র কাজ চলছে জোরকদমে, তখন সেই কমিটির ভূতপূর্ব সদস্য, গান্ধীর একনিষ্ঠ অনুগামী অর্থনীতিবিদ জে সি কুমারাপ্পা নেহরুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, এই কমিটির চেয়ারম্যান হতে সম্মত হয়ে তিনি অহিংসার নীতিটিকে ভেঙেছেন। শিল্পায়নের এই সমালোচনার শিকড় খুঁজলে পৌঁছতে হবে হিন্দ স্বরাজ-এ, যেখানে গান্ধী শিল্পায়নকে দেখেছেন পাশ্চাত্য সভ্যতার একটি অভিশাপ হিসাবে— যেখানে আত্মার উন্নতি নয়, কেবলমাত্র পার্থিব সুখের সন্ধানই চালিকাশক্তি। এই সমালোচনা থেকে তার আধ্যাত্মিক অংশটুকু যদি বাদও দেওয়া যায়, তবু পড়ে থাকে একটি বৃহৎ প্রশ্ন— শিল্পায়নের চূড়ান্ত অভীষ্ট তা হলে কী?আরও সম্পদ নির্মাণ? আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা? আরও ভোগের আয়োজন? আধুনিক ভোগবাদ-তাড়িত শিল্পায়নের বিরুদ্ধে এ-হেন মৌলিক প্রশ্ন সওয়া এক শতাব্দী পরেও কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায়, যখন একুশ শতকের পরিবেশবাদীরা বারে বারেই ফিরে যান গান্ধীর এই সমালোচনার কাছে। সুস্থ জীবনধারণের জন্য কতখানি ভোগ অপরিহার্য, তার জন্য কতটুকু উৎপাদন করা জরুরি, কোথায় লক্ষ্মণরেখা টানলে ভবিষ্যৎ সুস্থায়ী হতে পারে, গান্ধীর দর্শন এই প্রশ্নগুলি করে, করতে সাহায্য করে— সেখানেই তাঁর তাৎপর্য।

ভিন্ন মার্গের দর্শনের অনুসারী হয়েও কী ভাবে এমন মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা সম্ভব, তার উদাহরণ পাওয়া যাবে কুমারাপ্পার চিঠির জবাবে নেহরুর অবস্থানে। হিংসার প্রশ্নটিকে নেহরু দেখলেন শিল্পায়নের মধ্যে নিহিত শোষণ ও বৈষম্যের সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে। এবং জানালেন, রাষ্ট্র যদি সম্পদের অসম বণ্টনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া বৈষম্য বিষয়ে সচেতন হয়, যদি বণ্টনের প্রশ্নটিকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয়, তবে এই প্রক্রিয়া থেকে হিংসাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব। নেহরু বললেন, বস্তুত এই সমতর বণ্টনের নীতি যাতে কেবলমাত্র দারিদ্রই বণ্টন না করে, যেন ভারতের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছে একটি ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান, সবার জন্য উন্নয়নের সমান সুযোগ এবং ক্রমবর্ধমান স্বাচ্ছন্দ্য পৌঁছে দেওয়া যায়, তার জন্যই প্রয়োজন দ্রুত শিল্পায়ন। গান্ধীর তোলা নৈতিকতার প্রশ্নটিকে নেহরু স্থাপন করলেন আর এক নৈতিকতার জমিতে। নেহরু যা বলেছিলেন, তাঁর ভারত সে কাজ আদৌ পেরেছিল কি না, তা পৃথক আলোচনার বিষয়— কিন্তু, নিজের অবস্থানের মধ্যে ভিন্ন মতকে জায়গা করে দিতে পারার মতো উদারতা আজকের ভারতে ফিরিয়ে আনা গেলে দেশের উপকার হত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Netaji Subhas Chandra Bose jawaharlal nehru

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy